কবিগুরুর এই কথাটা আমার মনে পড়ল।
আজ ২৭ শে এপ্রিল শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক সাহেবের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী। পাঁচ বৎসর পূর্বে (১৯৬২) যখন তিনি ঢাকায় মারা যান সেদিনও আমি জেলে ছিলাম। হক সাহেব ছিলেন পূর্ব বাংলার মাটির মানুষ এবং পূর্ব বাংলার মনের মানুষ। মানুষ তাঁহাকে ভালবাসতো ও ভালবাসে। যতদিন বাংলার মাটি থাকবে বাঙালি তাকে ভালবাসবে। শেরে বাংলার মতো নেতা যুগ যুগ পরে দুই একজন জন্মগ্রহণ করে।
শেরে বাংলা হক সাহেব ১৯৪০ সালে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব পেশ করেন এবং সেই প্রস্তাবের জন্যই আজ আমরা পাকিস্তান পেয়েছি। লাহোর প্রস্তাবে যে কথাগুলি ছিল আমি তুলে দিলাম-নিখিল ভারত মুসলিম লীগ তথা এ দেশের কয়েক কোটি মুসলমান দাবি করিতেছে যে সব এলাকা একান্তভাবেই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ, যেমন উত্তর পশ্চিম সীমান্ত এলাকা এবং ভারতের পূর্বাঞ্চল, প্রয়োজন অনুযায়ী সীমানার বদল করিয়া ঐ সকল এলাকাকে ভৌগোলিক দিক দিয়া এরূপভাবে পুনর্গঠিত করা হউক যাহাতে উহারা স্বাধীন ও স্বতন্ত্র স্টেটস্-এর রূপ পরিগ্রহণ করিয়া সংশ্লিষ্ট ইউনিটদ্বয় সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌমত্বের মর্যাদা লাভ করিতে পারে। …
এই লাহোর প্রস্তাবের কথা বললে আজ অনেক তথাকথিত নেতারা ক্ষেপে যান এবং আমাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে শুধু গালি দেন বা কারাগারেও বৎসরের পর বৎসর বন্দি করে রাখেন। যে দিন লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র গঠন করা যাবে সেইদিনই শেরে বাংলার প্রতি শ্রদ্ধা দেখান হবে এবং তাঁর আত্মা শান্তি পাবে।
শেরে বাংলা তাঁর নিজের সম্বন্ধে যা নিজেই লেখে রেখে গেছেন তা হলো :
Self Analysis
“In my stormy and chequered life chance has played more than her fair part. The fault has been my own. Never at any time have I tried to be the complete master of my own fate. The strongest impulse of the moment has governed all my actions. When chance has raised me to dazzling heights, I have received her gifts without-stretched hands. When she has cast me down from my high pinnacle, I have accepted her buffets without complaint. I have my hours of pinnacle and regret. I am introspective enough to take an interest in the examination of my own conscience. But this self-analysis has always been ditched. It has never been morbid. It has neither aided nor impeded the fluctuations of my varied career. It has availed me nothing in the external struggle which man wages on behalf of himself against himself. Disappointments have not cured me of ineradicable romanticism. If at times I am sorry for something I have done, remorse assails me only for the things I have left undone.’
Fazlul Haq
শেরে বাংলার এই সামান্য কথা থেকে আমরা তাঁর জীবনের বৈশিষ্ট্য বুঝতে পারি।
আজ লাহোর প্রস্তাবের মালিকের মৃত্যুবার্ষিকী। আর লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তি করে আমি যে ৬ দফা দাবি পেশ করেছি তার উপর বক্তৃতা করার জন্য এ দিনটিতে আমাকে ১৫ মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হলো। আল্লার মহিমা বোঝা কষ্টকর।
২৮শে এপ্রিল—৩০শে এপ্রিল ১৯৬৭
কারাদণ্ড হওয়ার পরে জেলের ভিতরে যখন আমি ফিরে এলাম। এসেই শুনলাম আমার ভিতরে আসার পূর্বেই সাধারণ কয়েদিরা খবর পেয়েছে যে, আমাকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অনেকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করল এই জুলুমের কি কোনো প্রতিকার নাই? এদের চোখে মুখে বেদনা ভরা। দুই একজন তো কেঁদেই দিল। আমি ওদের হাসতে হাসতে বললাম, দুঃখ করবেন না। আমি তো এই পথে জেনে শুনেই নেমেছি। দুঃখ তো আমার কপালে আছেই। দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালবাসলে, কষ্ট ও জুলুম স্বীকার করতে হয়। আমার কাছে কোনো কয়েদির দেখা করা বা কথা বলা নিষেধ। তবুও সিপাহি জমাদারদের বলে এরা ফাঁকে ফাঁকে পালাইয়া আসে। কত দরদ ভরা এদের মন। কেন যে এরা আমাকে ভালবাসে আজও বুঝতে পারলাম না। পাষাণ প্রাচীর ঘেরা এই কারাগারের বন্দি কয়েদিরাও আজ চায় নিজের অধিকার নিয়ে বাঁচতে। তারাও বুঝতে শুরু করেছে তাদের শোষণ করছে কোনো এক অঞ্চলের এক শোষকগোষ্ঠী। দিন ভরেই কয়েদিরা আসছে আর আফসোস করছে। হায়রে বাঙালি শুধু কাঁদতেই শিখেছে আর কিছুই করার ক্ষমতা তোমাদের নাই!
আজ ১৪ দিন হয়ে গেছে, রেণু তার ছেলেমেয়ে নিয়ে দেখা করতে আসবে বিকাল সাড়ে চারটায়। চারটার সময় আমি প্রস্তুত হয়ে রইলাম। পৌনে পাঁচটায় সিপাহি আসলো আমাকে নিতে। আজ তো আমি সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি, আইবি অফিসার আইনতভাবে আমরা যখন আলাপ করবো তখন থাকতে পারবে না। যেয়ে দেখলাম আইবি অফিসার ঠিকই এসেছে তবে কিছু দূরে বসে আছে। আমরা যে রুমে বসে আলাপ করবো সে রুমে বসে নাই। রুমে এলে আমি বাধ্য হতাম তাকে বের করে দিতে। আর দিতামও। বহুদিন পরে ছেলেমেয়েদের ও রেণুর সাথে প্রাণ খুলে কথা বললাম। প্রায় দেড় ঘণ্টা। ঘর সংসার, বাড়ির কথা আরও অনেক কিছু। আমার শাস্তি হয়েছে বলে একটুও ভীত হয় নাই, মনে হলো পূর্বেই এরা বুঝতে পেরেছিল। রেণু বলল, পূর্বেই সে জানতো যে আমাকে সাজা দিবে। দেখে খুশিই হলাম। ছেলেমেয়েরা একটু দুঃখ পেয়েছে বলে মনে হলো, তবে হাবভাবে প্রকাশ করতে চাইছে না। বললাম, তোমরা মন দিয়ে লেখাপড়া শিখ, আমার কতদিন থাকতে হয় জানি না। তবে অনেকদিন আরও থাকতে হবে বলে মনে হয়। আর্থিক অসুবিধা খুব বেশি হবে না, তোমার মা চালাইয়া নিবে। কিছু ব্যবসাও আছে আর বাড়ির সম্পত্তিও আছে। আমি তো সারাজীবনই বাইরে বাইরে অথবা জেলে জেলে কাটাইয়াছি তোমার মা’ই সংসার চালাইয়াছে। তোমরা মানুষ হও।’ ছোট মেয়েটা বলল, ‘আব্বা এক বৎসর হয়ে গেল।‘ আমি ওকে আদর করলাম, চুমা দিলাম। আর বললাম, ‘আরও কত বৎসর যায় ঠিক কি?’ আপীল করবার কথা বললাম। আর নোয়াখালী, সিলেট, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও পাবনার মামলাগুলির কাগজপত্র আনাতে এবং হাইকোর্টে মামলা করতে বললাম যাতে সকল মামলা ঢাকায় আনা হয়। জেলে বসেই নিম্ন আদালতের বিচারগুলি হয়ে যায়। সবই বক্তৃতার মামলা।