আমি কারাগার থেকে আমার দেশবাসীকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাই।
১০ সেল থেকে মিজানুর রহমান চৌধুরী আমাকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাইয়া একটা টুকরা কাগজে নিম্নলিখিত কবিতাটা লিখে পাঠায়,
‘আজিকের নূতন প্রভাতে নূতন বরষের আগমনে
– মুজিব ভাইকে’
‘বন্ধু হও, শত্রু হও, যেখানে যে কেউ রও,
ক্ষমা কর আজিকার মত,
পুরাতন বরষের সাথে,
পুরাতন অপরাধ হতে।‘
নববর্ষের শ্রদ্ধাসহ মিজান
১লা বৈশাখ ১৩৭৪ সাল।
১৩৭৩ সালের বৈশাখ হতেই আমার উপর সরকারের জুলুম পুরাদমে শুরু হয়। এর পূর্বেও পঁচটা মামলা ঢাকা কোর্টে দায়ের করা হয়। একটি মামলায় আমাকে ঢাকার এডিসি জনাব বদিউল আলম এক বৎসরের জেল দেয়, হাইকোর্ট আমাকে জামিনে মুক্তি দেয়। অন্য মামলাগুলি চলছিল। ৩রা বৈশাখ খুলনায় মিটিং করে ঢাকায় মোটরে ফেরার পথে ৪ঠা বৈশাখ আমাকে যশোরে গ্রেপ্তার করে এবং জামিনে মুক্তি পেয়ে ঢাকায় ফিরে আসি।
৭ই বৈশাখ আবার আমাকে ঢাকায় গ্রেপ্তার করে সিলেটে পাঠায়।
৮ই বৈশাখ আমার জামিনের আবেদন মহকুমা হাকিম অগ্রাহ্য করে জেল হাজতে প্রেরণ করে। ৯ই বৈশাখ জেলা জজ বাহাদুর আমাকে জামিনে মুক্তি দেন। পুনরায় জেল গেটে গ্রেপ্তার করে ময়মনসিংহ জেলে প্রেরণ করে।
১০ই বৈশাখ আমার জামিনের আবেদন অগ্রাহ্য করে আমাকে জেলে পাঠাইয়া দেয়।
১১ই বৈশাখ জেলা জজ আমাকে জামিনে মুক্তি দেন আমি মোটরে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করি।
২৪শে বৈশাখ তাজউদ্দীন আহমদ, খোন্দকার মোশতাক আহমদ, নূরুল ইসলাম চৌধুরী, জহুর আহমেদ চৌধুরী, মুজিবুর রহমান (রাজশাহী) ও আমাকে ডিপিআর হিসাবে গ্রেপ্তার করে ঢাকা জেলে বন্দি করে এবং চট্টগ্রামে জনাব এম, এ আজিজকে গ্রেপ্তার করে চট্টগ্রাম জেলে বন্দি করে। ২৪শে বৈশাখ থেকে আজ পর্যন্ত কারাগারেই বন্দি আছি।
১৬ই এপ্রিল–২২শে এপ্রিল ১৯৬৭
শরীর কেন যেন আবার কিছুটা খারাপ হয়েছে। কয়েকদিন পর্যন্ত মাথার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে স্যারিডন খাই। খাওয়ার পরে কিছু সময় ভাল থাকি, আবার মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়, আবার খাই। এইভাবে তিন দিন চলে। মাথার যন্ত্রণা হলে লেখাপড়া করতে পারি না, লেখাপড়া না করলে সময় কাটাই কি করে?
কিছু সময় আজকাল শাহ মোয়াজ্জেমের সাথে আলাপ করতে সুযোগ পাই। ডিপিআর থেকে মুক্তি পেয়ে ও বন্দি আছে কয়েদি হয়ে, এখনও জামিন পায় নাই, কয়েকদিনের মধ্যে জামিন হয়ে যাবে।পুরানা ২০ সেলে রেখেছে। প্রায় একমাস সাধারণ কয়েদি থেকে দুই তিন দিন হলো ডিভিশন পেয়েছে। খোন্দকার মোশতাক আহমদ ও আবদুল মোমিন সাহেব হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মোশতাক সাহেবের শরীর খুবই খারাপ, অনেক ওজন কম হয়ে গেছে। মোমিন সাহেব এখন ভাল। তাদের সাথে দেখা হয়েছিল হাসপাতালের দরজায়। তারা সব দলের ঐক্য চায়, তবে পূর্ব বাংলার দাবি ছেড়ে নয়, ত্যাগ করতে প্রস্তুত আছে। মোমিন সাহেব নতুন জেলে এসেছেন কিন্তু একটুও ঘাবড়ান নাই। খুবই শক্ত। আদর্শনিষ্ঠা আছে, পূর্ব বাংলাকে ভালবাসে, সংগ্রাম চালাইয়া যেতে পারবে। মোশতাক সাহেব তো পুরানা পাপী। অত্যন্ত সহ্য শক্তি, আদর্শে অটল। এবার জেলে তাকে বেশি কষ্ট দিয়েছে। একবার পাবনা জেলে, একবার রাজশাহী জেলে আবার ঢাকা জেলে নিয়ে। কিন্তু সেই অতি পরিচিত হাসি খুশি মুখ।
নূরুল ইসলাম ও নূরে আলম সিদ্দিকী পুরানা ২০ সেলে থাকে। একটু সুযোগ পেলেই ছুটে আমার কাছে চলে আসে, সিপাহিদের মুখ শুকাইয়া যায়। জমাদার সাহেবরা কি বলবে? ছেলে মানুষ এরা, জেলের আইন টাইন বেশি মানতে চায় না। আমি বুঝাইয়া রাখি। নূরুল ইসলাম পুরানা কর্মী। যথেষ্ট বুদ্ধি রাখে। মাঝে মাঝে ওর সাথে আমি পরামর্শ করি। বড় শান্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়লেও, জানার ও পড়ার আগ্রহ আছে। আমি ওকে খুবই স্নেহ করি। আজ প্রায় ১০ বৎসর আমার সাথেই আছে। যাহা হুকুম করি হাসিমুখে পালন করে। আর্থিক অবস্থা সচ্ছল না।
নূরে আলম সিদ্দিকী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ভাল লেখাপড়া জানে, এমএ প্রথম ভাগ জেল থেকেই দিয়েছে, দ্বিতীয় শ্রেণীতে পাশ করেছে। বয়স খুবই অল্প। বাংলা ভাষার উপর অধিকার আছে। চমৎকার বক্তৃতাও করে। দেশের প্রতি ভালবাসা আছে। বাংলার মানুষকে ভালবাসে। কিছুটা চঞ্চল প্রকৃতির। তাই একটু বেশি কথা বলে, বয়সের সাথে ঠিক হয়ে যাবে। রক্ত কপোত’ নামে একটা বই লেখার জন্য একটা মামলার আসামি আছে, মাঝে মাঝে কোর্টে যায়। ছাত্রদের সাথে কোর্টে গেলে দেখা হয় তাতে খুব আনন্দ পায়। তার মা মারা গেছেন। বাবার একমাত্র ছেলে। খুবই আদরের। মাঝে মাঝে বাবা মার কথা বলে। তাকে আমি খুবই স্নেহ করি। প্রথম প্রথম ভেবেছিল ছেড়ে দিবে এখন সহজে ছাড়া পাবে না বুঝতে পেরেছে। কতদিন থাকতে হয় তাই মাঝে মাঝে ভাবে। একদিন আমাকে বলে, “বস, আপনাকে যদি ছেড়ে দেয় আর আমাকে রেখে দেয় তবে আমার দশাটা কি হবে?” ওকে অন্য জায়গায় নিতে চেয়েছিল, আমার কাছ থেকে যেতে চায় না। আমি বললাম, “তুমি পাগল, আমার মুক্তির অনেক দেরি কত বত্সর থাকতে হয় ঠিক নাই। আর আমি যখন মুক্তি পাব তার অনেক পূর্বেই তোমরা ছাড়া পাবা। মনে রেখ থরোর কথা-
“Under a government which imprisons any unjustly, the place for a just man is also a Prison.’
আমি ভালই আছি। যেখানে বিচার নাই, ইনসাফ নাই, সেখানে কারাগারে বাস করাই শ্রেয়।