আজকাল শাসন ব্যবস্থা যা হয়েছে, হলে হতেও পারে। জানি না সত্য কি মিথ্যা তবে কানে এসেছে জনাব মোনেম খান সাহেব নাকি হুকুম দিয়েছেন আওয়ামী লীগ বিশেষ করে আমার কোনো ব্যাপার হলে তাকে খবর দিতে হবে এবং অনুমতি নিতে হবে। চীফ সেক্রেটারী বা সেক্রেটারী সাহেবও কোনো কিছুর অনুমতি দিতে পারেন না। ১৪ দিন পরে একদিন দেখা আইনে আছে, তাই বোধ হয় তিনি বন্ধ করেন নাই মেহেরবানি করে। হুকুম দিলেই বন্ধ হয়ে যেত, বড়ই দয়া করেছেন! টাকা আনা, খাবার আনা, সকল কিছুই তো বন্ধ করে দিয়েছেন যাতে কারাগারের রাজনৈতিক বন্দিরা কষ্ট পায় এবং আদর্শচ্যুত হয়ে যায়, বন্ড দিয়ে বের হয়ে যায়। ভুল করেছেন তিনি-এঁরা ভেঙে যেতে পারে, কিন্তু বাঁকা হবে না। নীতির জন্য, আদর্শের জন্য এবং দেশের মানুষের জন্য যারা ছেলেমেয়ে সংসার ত্যাগ করে কারাগারে থাকতে পারে, যে কোনো কষ্ট স্বীকার করবার জন্য তারা প্রস্তুত হয়েই এসেছে।
জেল গেটে যখন উপস্থিত হলাম ছোট ছেলেটা আজ আর বাইরে এসে দাঁড়াইয়া নাই দেখে একটু আশ্চর্যই হলাম। আমি যখন রুমের ভিতর যেয়ে ওকে কোলে করলাম আমার গলা ধরে আব্বা আব্বা করে কয়েকবার ডাক দিয়ে ওর মার কোলে যেয়ে আব্বা আব্বা করে ডাকতে শুরু করল। ওর মাকে ‘আব্বা বলে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাপার কি?’ ওর মা বলল, “বাড়িতে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কাঁদে তাই ওকে বলেছি আমাকে আব্বা বলে ডাকতে।” রাসেল আব্বা আব্বা বলে ডাকতে লাগল। যেই আমি জবাব দেই সেই ওর মার গলা ধরে বলে, তুমি আমার আব্বা। আমার উপর অভিমান করেছে বলে মনে হয়। এখন আর বিদায়ের সময় আমাকে নিয়ে যেতে চায় না।
এক ঘণ্টা সময়। সংসারের কথা, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, আব্বা মার শরীরের অবস্থা আলোচনা করতে করতে চলে যায়। কোম্পানী আজও আমার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা দেয় নাই, তাই একটু অসুবিধা হতে চলেছে বলে রেণু বলল। ডিসেম্বর মাসে আমি চাকরী ছেড়ে দিয়েছি-চারমাস হয়ে গেল আজও টাকা দিল না! আমি বললাম, “জেল থেকে টেলিগ্রাম করব। প্রথম যদি না দেয় তবে অন্য পন্থা অবলম্বন করব। আমার টাকা তাদের দিতেই হবে। কোনোমতে চালাইয়া নিয়ে যাও। বাড়ির থেকে চাউল আসবে, নিজের বাড়ি, ব্যাঙ্কেও কিছু টাকা আছে, বছর খানেক ভালভাবেই চলবে, তারপর দেখা যাবে। আমার যথেষ্ট বন্ধু আছে যারা কিছু টাকা ধার দিতে কৃপণতা করবে না। যদি বেশি অসুবিধা হয় নিজের বাড়ি ভাড়া দিয়ে ছোট বাড়ি একটা ভাড়া করে নিব’, রেণু বলল। সরকার যদি ব্যবসা করতে না দেয় তবে বাড়িতে যে সম্পত্তি আমি পেয়েছি আব্বার, মায়ের ও রেণুর তাতে আমার সংসার ভালভাবে চলে যাবে। রেণু বলল, “চিন্তা তোমার করতে হবে না। সত্যই আমি কোনোদিন চিন্তা বাইরেও করতাম না, সংসারের ধার আমি খুব কমই ধারি’।
সরকারের এক বিশেষ দফতরের একজন কর্মচারী যার সাথে পাকিস্তান আন্দোলনের সময় কলকাতায় পরিচয় ছিল—তিনি সোহরাওয়ার্দী সাহেবেরও ভক্ত ছিলেন এবং চাকরি করতেন। কলকাতায় বাড়ি। আমাকে কিছু মিষ্টি পাঠাইয়াছেন এই কথা বলে আমি যেন তার এই সামান্য উপহারটুকু গ্রহণ করি। এর সাথে বহুদিন আমার দেখা হয় নাই। তিনি আরো বলেছেন, ছয় দফা দাবি সমর্থন প্রায়ই সকলে করে তবে বলতে পারে না। এঁর পরিচয় আজ দেওয়া উচিত হবে না, কারণ সে এক বিশেষ দফতরে আছে। সরকার খবর পেলে শুধু চাকরিই নিবে না, জেলেও দিতে পারে।
আজ বাংলা নববর্ষ, ১৫ই এপ্রিল। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি নরে আলম সিদ্দিকী, নূরুল ইসলাম আরও কয়েকজন রাজবন্দি কয়েকটা ফুল নিয়ে ২০ সেল ছেড়ে আমার দেওয়ানীতে এসে হাজির। আমাকে কয়েকটা গোলাপ ফুল দিয়ে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাল। ২৬ সেল হাসপাতাল থেকে বন্ধু খোন্দকার মোশতাক আহমদও আমাকে ফুল পাঠাইয়াছিল। আমি ২৬ সেল থেকে নতুন বিশ সেলে হাজী দানেশ, সৈয়দ আলতাফ হোসেন, হাতেম আলি খান, সিরাজুল হোসেন খান ও মৌলানা সৈয়াদুর রহমান সাহেব, ১০ সেলে রফিক সাহেব, মিজানুর রহমান, মোল্লা জালালউদ্দিন, আবদুল মোমিন, ওবায়দুর রহমান, মহিউদ্দিন, সুলতান, সিরাজ এবং হাসপাতালে খোন্দকার মোশতাক সাহেবকে ফুল পাঠাইলাম নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে। শুধু পাঠাতে পারলাম না পুরানা হাজতে, যেখানে রণেশ দাশগুপ্ত, শেখ ফজলুল হক (মণি)—আমার ভাগনে, হালিম, আবদুল মান্নান ও অন্যরা থাকে—এবং ১/২ খাতায় যেখানে শ্রমিক নেতারা, ওয়াপদার কর্মচারী ও কয়েকজন ছাত্র থাকে। তাদের মুখে খবর পাঠাইলাম আমার শুভেচ্ছা দিয়ে। জেলের ভিতর অনেক ছোট ছোট জেল; কারও সাথে কারও দেখা হয় না-বিশেষ করে রাজনৈতিক বন্দিদের বিভিন্ন জায়গায় রাখা হয়েছে। এরা তো রাষ্ট্রের শত্রু’! বিকালে পুরানা বিশ সেলের সামনে নূরে আলম সিদ্দিকী, নূরুল ইসলাম ও হানিফ খান কম্বল বিছাইয়া এক জলসার বন্দোবস্ত করেছে। বাবু চিত্তরঞ্জন সুতার, শুধাংশু বিমল দত্ত, শাহ মোয়াজ্জেম আরও কয়েকজন ডিপিআর ও কয়েদি, বন্দি জমা হয়ে বসেছে। আমাকে যেতেই হবে সেখানে, আমার যাবার হুকুম নাই তবু আইন ভঙ্গ করে কিছু সময়ের জন্য বসলাম। কয়েকটা গান হলো, একজন সাধারণ কয়েদিও কয়েকটা গান করল। চমৎকার গাইল। শিক্ষিত ভদ্রলোকের ছেলে, প্রেম করে একজনকে বিবাহ করেছিল। পরে মামলা হয়। মেয়েটা বাবা মায়ের চাপে উল্টা সাক্ষী দেয় এবং নারীহরণ মামলায় ৭ বৎসরের জেল নিয়ে এসেছে। ছোট হলেও জলসাটা সুন্দর করেছিল ছেলেরা।