জেলে শব্দকোষের কয়েকটি এ রকম :
রাইটার দফা-যারা লেখাপড়া জানে, অফিসের কাজ করে, চিঠিপত্র লিখে দেয়, হিসাব রাখে, আপীল লিখে দেয়, দরখাস্ত লিখে দেয়, চিঠিপত্র বিলি করে। কয়েদিদের খালাসের সময় হিসেব করে। কতদিন জেলখাটা হলো। হাসপাতালে কাজ করে, ঔষধপত্র হিসেব রাখে। একজন কর্মচারীকে কাজে সাহায্য করার জন্য একজন দুইজন অথবা বেশি রাইটার থাকে। এরা কর্মচারীদের কাজে সাহায্য করে। মাল গুদামের হিসেব রাখে, কয়েদিদের বেতন ভাগ করে দেয়, বাজার থেকে কি কি কিনতে হবে—তাহাও লিখে কর্মচারীদের দস্তখত নিয়ে কন্ট্রাক্টরদের কাছে পাঠায়। যত গোলমাল, এই রাইটারই বেশি করে।
চৌকি দফা—যেখানে কয়েদিদের পাক (রান্না) হয়। হিন্দু এবং মুসলমানদের আলাদা আলাদাভাবে পাক হয়ে থাকে। এখানে বহু কয়েদি কাজ করে। পানি আনে, মাছ ও তরকারি কোটে, মরিচ বাটে, খাওয়া বিলি করে, যাবতীয় খাওয়ার ব্যাপার এই চৌকি থেকে হয়। বহু লোকের পাক হয়। ডিভিশন চৌকি আলাদা হয়ে থাকে। ডিভিশন অর্থ হলো যে সমস্ত কয়েদিদের বাইরে অবস্থা ভাল, শিক্ষিত, সম্মানিত জেলে এসে পড়েছে তাদের ডিভিশন দেওয়া হয়। এক কথায় বলতে গেলে এদের উচ্চ শ্ৰেণী বলা চলে। এদের কনভিক্ট ডিভিশন-২ বলা হয়; ডিভিশন-১ও আছে। যারা হাজতি তারা ডিভিশন-১ পায়। যারা কনভিক্ট তাদের ডিভিশন-২ বলা হয়। আর আছে সাধারণ শ্রেণী যাদের তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদি বলা হয়। ডিভিশন কয়েদিরা জুতা, জামা, খাট, মশারি পায়। আর জেলখানায় একটু মাতব্বরীও বেশি করতে চেষ্টা করে। আর করেও। কারণ প্রায়ই লেখাপড়া জানা ও অবস্থাসম্পন্ন লোক অথবা সরকারি কর্মচারী ঘুষ খেয়ে সাজা পেয়ে জেলে এসেছে। এদের পাকও আলাদা হয়। কারণ এরা রোজই মাছ, তরকারি, অন্যান্য জিনিস সাধারণ কয়েদিদের থেকে বেশি পায়। এদেরই এক কথায় সুখী কয়েদি বলা চলে। চৌকি দফায় যারা কাজ করে ও মেট পাহারা যারা থাকে, পরিশ্রম করতে হয় তাদের বেশি। খাওয়া দাওয়ার কষ্ট হয় না। অনেক কিছু তৈয়ার করে পালাইয়া পালাইয়া খেয়ে থাকে, আর বিক্রিও করে। আশ্চর্য হবেন, বিক্রির ইতিহাস পরে আলোচনা করা যাবে। জেলখানায় পাওয়া যায় না এমন জিনিস খুব অল্পই আছে। তবে মেয়েলোক শুধু পাওয়া যায় না।
জলভরি দফা-বুঝতে বোধহয় কষ্ট হবে না, জলভরি কাকে বলে। কয়েদিদের মধ্যে একটা দফা আছে যারা পানি টানে ও ওয়ার্ডে পানি দেয়। বেশ শক্তিশালী লোক দেখে এই দফা পূরণ করা হয়। সকালে বাঁশের ভিতর দুইটা করে বড় বালতিতে পানি ভরে প্রত্যেক ওয়ার্ডে হাউজ আছে তাতে ভর্তি রাখতে হয়। এদের কষ্ট একটু বেশি, কারণ তিন তলা পর্যন্ত হাউজে পানি তুলতে হয়, সকালে ও বিকালে। যদি কোনো ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট, দারোগা, পুলিশ, দফাদার কয়েদি হিসাবে জেলে আসে তখন কয়েদিরা এক হয়ে তাদের দিয়ে পানি টানায় এবং নিচের থেকে তিন তলায় পানি টানায়।
ঝাড়ু দফা-এদের কাজ ঝাড় দেওয়া, ময়লা পরিষ্কার করা। বুড়া বুড়া, অসুস্থ লোক দেখে এখানে দেওয়া হয়। দিনভর গাছের পাতা, সামান্য ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করতে হয়। এরাই সুখী বেশি কারণ কাজ নাই তবে ইদানীং নতুন সুপারেনটেনডেন্ট ঢাকা জেলে আসাতে এদের উপর কাজের চাপ একটু বেশি পড়েছে। কারণ তিনি গাছের পাতা দেখলে কয়েদিদের মেট পাহারাদের দিয়ে সেল বন্ধ করে শাস্তি দেন। তবে কয়েদিরাও চালাক কম না। একদিন বসে আছি হঠাৎ শুনতে পেলাম একজন কয়েদি আর একজন কয়েদিকে বলছে আরে ভাই, ঝাড় মার ঝাড় মার বড় সাহেব আসছে। আমি সহজে বুঝতে পারলাম না কেন বড় সাহেবকে ঝাড় মারতে চায়। পরে জিজ্ঞাসা করে জানলাম যে, ইনি খুব কড়া লোক। তাই কয়েদিরা ঝাড় মারে মাটিতে, বলে সুপার সাহেবের নামে। পরে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে।
বন্দুক দফা-একটা বিখ্যাত দফা আছে যার নাম কেহই বুঝবেন না, একে বন্দুক দফা বলা হয়। একদল কয়েদি আছে যারা মেথরের কাজ করে। মেথর হলে রোজ মাছ পাওয়া যায়। তেল পাওয়া যায়। আঁটি করে বিড়ি পাওয়া যায়, সাবানও পাওয়া যায়। লোভে পরে অনেকে মেথর দফায় কাজ করে, পায়খানা পরিষ্কার করে। আগে জুলুম করে, মারপিট করে মেথর করতে হতো। সহজে কেহ মেথর হতে চায় না। তাই অত্যাচার করার জন্য কয়েদিদের মধ্য থেকে দালাল ঠিক করে দেওয়া হতো। আপনারা জিজ্ঞাসা করতে পারেন, বন্দুক দফা কেন বলা হয়? একটা গল্প আছে এর পেছনে। বাঁশ দিয়ে কাঁধে নিয়ে টিনে করে পায়খানার ময়লা দূরে নিয়ে লাল গাড়িতে ফেলতে হয়। তাই টিন ঘাড়ে করে টানতে টানতে দাগ হয়ে যায়। একজন কয়েদি মেথর দফায় কাজ করতে করতে তার কাঁধে দাগ হয়ে যায়। একবার তার ভাইরা তাকে দেখতে এসে কাঁধের দাগ দেখে জিজ্ঞাসা করে দাগ কিসের, তার উত্তরে মেথর কয়েদিটা বলে আমি বন্দুক দফায় জেলখানায় কাজ করি, সিপাহি সাহেবদের বন্দুক আমার বহন করে বেড়াতে হয়। তাই দাগ পড়ে গেছে। সেই হতে এই দফার নাম বন্দুক দফা।
পাগল দফা-জেলখানায় আরেকটা দফার নাম পাগল দফা। জেলখানায় বহু পাগল আছে। এদের আলাদা রাখার ব্যবস্থা আছে, এদের জন্য সকালে একজন সিপাহি, বিকেলে একজন। কয়েদিদের মধ্য থেকে মেট পাহারা কয়েকজন রাখা হয় এদের দেখাশোনা করার জন্য। অনেক কয়েদি পাগল হয়ে যায়, বেশি দিন জেল জীবন সহ্য করতে পারে না বলে। অনেক কয়েদি আপনজনকে হত্যা করে পাগল হয়ে যায়। এরা ভাল না হওয়া পর্যন্ত বিচার বন্ধ থাকে। ফরিদপুরের এক পুলিশের হাওলাদার তার স্ত্রীর চরিত্রের উপর সন্দেহ করে স্ত্রী ও কন্যাকে হত্যা করে। বিচারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। তারপর সে পাগল হয়ে যায়। আবার অনেকে বাইরে পাগল হয়, আত্মীয় স্বজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের অনুমতি নিয়ে জেলে পাঠাইয়া দেয়। অনেকে ভাল হয়, আবার অনেকে বেশি পাগল হয়ে যায়। দুনিয়ায় কত রকমের পাগল আছে জেলে আসলে বোঝা যায়। আমার কপাল ভাল কি মন্দ বলতে পারি না। তবে যেখানে পাগলদের রাখা হয় তার কাছেই আমাকে রাখা হয়েছিল। রাত হলে পাগলের পাগলামি বাড়ে। ৪০ সেলে পাগল রাখা হয়। এক এক সেলে এক এক জনকে বন্ধ করা হয়। অনেকে চুপচাপ থাকে, আবার অনেকে সারারাত গান গায়—কত রকমের গান ঠিক নাই। যাকে এক কথায় পাগলের গান বলা যায়। মাঝে মাঝে থালা পিটায়, মাঝে মাঝে দরজা ধরে ধাক্কা শুরু করে। আর মাঝে মাঝে দু’একজন রাতভরে গালাগালি করে। কাকে করে বুঝতে পারি না—তবে গালাগালি চালিয়ে যায়।