১৯৫৮ থেকে ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পাখি দুইটা আসত। এবার এসে তাদের কথা আমার মনে আসে, আমি খুঁজতে শুরু করি। এবারও ঠিক একই সময় দু’টা হলদে পাখি এখানে আসত। মনে হয় ওদেরই বংশধর ওরা। তারা বোধ হয় বেঁচে নাই অথবা অন্য কোথাও চলে গিয়াছে। ১০টা-১১টার মধ্যে ওদের কথা এমনি ভাবেই আমার মনে এসে যায়। চক্ষু দুইটা অমনি গাছের ভিতর নিয়া ওদের খুঁজতে থাকি। কয়েকদিন ওদের দেখতে পাই না। রোজই আমি ওদের খুঁজি। তারা কি আমার উপর রাগ করে চলে গেল? আর কি ওদের আমি দেখতে পাব না? বড় ব্যথা পাব ওরা ফিরে না আসলে। পাখি দুইটা যে আমার কত বড় বন্ধু যারা কারাগারে একাকী বন্দি থাকেন নাই তারা বুঝতে পারবেন না। আমাকে তো একেবারে একলা রেখেছে। গাছপালা, হলদে পাখি, চড়ুই পাখি আর কাকই তো আমার বন্ধু এই নির্জন প্রকোষ্ঠে। যে কয়েকটা কবুতর আমার বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছে তারা এখানে বাচ্চা দেয়। কাউকেও আমি ওদের ধরতে দেই না। সিপাহি জমাদার সাহেবরাও ওদের কিছু বলে না। আর বাচ্চাদেরও ধরে নিয়ে খায় না। বড় হয়ে উড়ে যায়। কিছুদিন ওদের মা-বাবা মুখ দিয়ে খাওয়ায়। তারপর যখন আপন পায়ের উপর দাঁড়াতে শিখে এবং মা-পায়রার নতুন ডিম দেওয়ার সময় হয় তখন ওই বাচ্চাদের মেরে তাড়াইয়া দেয়। আমি অবাক হয়ে ওদের কীর্তিকলাপ দেখি।
কাকের কাছে আমি পরাজিত হয়েছি। আমার সামনের আম গাছ কয়টাতে কাক বাসা করতে আরম্ভ করে। আমি বাসা করতে দেব না ওদের। কারণ ওরা পায়খানা করে আমার বাগান নষ্ট করে, আর ভীষণভাবে চিৎকার করে। আমার শান্তি ভঙ্গ হয়। আমি একটা বাঁশের ধনুক তৈয়ার করে মাটি দিয়ে গুলি তৈয়ার করে নিয়েছি। ধনুক মেরেও যখন কুলাতে পারলাম না তখন আমার বাগানী কাদের মিয়াকে দিয়ে বার বার বাসা ভেঙে ফেলি। বার বারই ওরা বাসা করে। লোহার তার কি সুন্দরভাবে গাছের সাথে পেঁচাইয়া ওরা বাসা করে। মনে হয় ওরা এক এক জন দক্ষ কারিগর, কোথা থেকে সব উপকরণ যোগাড় করে আনে আল্লাহ জানে! পাঁচটা আম গাছ থেকে ৫/৭ বার করে বাসা ভেঙে ফেলি, আর ওরা আবার তৈরি করে। ওদের ধৈর্য ও অধ্যবসায় দেখে মনে মনে ওদের সাথে সন্ধি করতে বাধ্য হই। তিনটা গাছ ওদের ছেড়ে দিলাম—ওরা বাসা করল। আর একটা গাছ ওরা জবর দখল করে নিল। আমি কাদেরকে বললাম, “ছেড়ে দেও। করুক ওরা বাসা। দিক ওরা ডিম। এখন ওদের ডিম দেওয়ার সময়-যাবে কোথায়?”
এই সমস্ত বাসা ভাঙবার সময় আমি নিজে ধনুক নিয়ে দাঁড়াতাম আর গুলি ছুঁড়তাম। ভয় পেয়ে একটু দূরে যেয়ে চিৎকার করে আরো কিছু সঙ্গী সাথী যোগাড় করে কাদেরকে গাছেই আক্রমণ করত। দুই একদিন শত শত কাক যোগাড় করে প্রতিবাদ করত। ওদের এই ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদকে আমি মনে মনে প্রশংসা করলাম। বাঙালিদের চেয়েও ওদের একতা বেশি।
এখন চারটা বাসায় ডিম দিয়েছে। একটা বাসায় বসে থাকে আর একটা পাহারা দেয়। দাঁড়কাক ওদের শত্রু। দুই পক্ষের যুদ্ধও দেখেছি। তুমুল কাণ্ড! ছোট কাকদের সাথে শেষ পর্যন্ত পারে না। দাঁড় কাক যুদ্ধ ভঙ্গ করে পালাইয়া যায়। বাঙালি একতাবদ্ধ হয়ে যদি দাঁড়কাকদের মত শোষকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াত তবে নিশ্চয়ই তারাও জয়লাভ করত। তাই কাকের অধ্যবসায়ের কাছে আমি পরাজিত হয়েছি। বিষয়টা নিয়ে ভেবে দেখে আমার মনে দুঃখও হয়েছে, কারণ আমার ঘর ভেঙেই তো আমাকে কারাগারে বন্দি করে রেখে দিয়েছে।
কিছুদিন পর্যন্ত কাকরা আমাকে দেখলেই চিৎকার করে প্রতিবাদ করত, ভাবত আমি বুঝি ওদের ঘর ভাঙবো। এখন আর আমাকে দেখলে ওরা চিষ্কার করে প্রতিবাদ করে না, আর নিন্দা প্রস্তাবও পাশ করে না।
১৩ তারিখে আমার ১৯৬৪ সালের আর একটা মামলা শুরু হয়েছে জেলগেটে। এটাও পল্টনের বক্তৃতার মামলা। ঢাকার এডিসি মিঃ খানকে সরকার স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে নিয়োেগ দিয়েছে। এটা ১২৪-এ ধারায় রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা। জেলগেটে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব এসেছিলেন। আমিও হাজির হয়েছিলাম। শুধু এডভোকেট মাহমুদুল্লা সাহেব এসেছিলেন। জহির, আবুল কেহই প্রথমে আসতে পারে নাই। আমি দরখাস্ত করতে বললাম। মামলা আজ হতে পারবে না কারণ আমার এডভোকেট সাহেবরা আজ আসতে পারবেন না।
ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আগামী ২২/৪/৬৭ তারিখে দিন ঠিক করে চলে গেলেন, ঠিক তার দুই মিনিট পরে জহির সাহেব এলেন।
নূরুল ইসলাম চৌধুরী, মোস্তফা, কামাল এসেছিল। কামাল পরীক্ষা ভালই দিয়েছে। এই খবরটার জন্য ব্যস্ত ছিলাম। আব্বা একটু ভালর দিকে চলেছেন। কিছু সময় কথাবার্তা বলে আমার পুরানা জায়গায় ফিরে এলাম। খোন্দকার মোশতাক জেল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তার শরীর খুবই খারাপ। আমার জায়গা থেকে আমি দেখলাম মোশতাক হাসপাতালের বারান্দায় চেয়ারে বসে রয়েছে। চেনাই কষ্টকর। বেচারাকে কি কষ্টই না দিয়েছে! একবার পাবনা, একবার রাজশাহী একবার ঢাকা জেল।
১৪ই এপ্রিল—১৫ই এপ্রিল ১৯৬৭
১৪ তারিখে ১৫ দিন পরে ছেলেমেয়েদের সাক্ষাৎ পেলাম। একটা দরখাস্ত করেছিলাম বিশেষ দেখার অনুমতি চেয়ে, ডিআইজি সাহেব অনুমতি তো দেনই নাই, জবাব দেওয়াও দরকার মনে করেন নাই। কারও কাছে দরখাস্ত আমি খুব একটা করি না, কারণ উত্তর না দিলে আত্মসম্মানে বাধে। আব্বা অসুস্থ তার সংবাদ পাওয়ার জন্য ব্যস্ত ছিলাম। সেকথাও লিখেছিলাম। বহু জেল খেটেছি এ অবস্থা কোনোদিন দেখি নাই। সকলেই বলে কি করব? উপরের চাপ। অর্থাৎ লাট সাহেবেরা নিষেধ করে দিয়েছেন। লাট সাহেব দেখার অনুমতি দিতে নিষেধ করেছেন এ কথা কে বিশ্বাস করবে?