৬ই এপ্রিল থেকে আমার বড় ছেলে কামাল ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিবে। কোনো খবর পাই নাই কেমন পরীক্ষা দিল।
আমি সরকার বা আইজির কাছে কোনো দরখাস্ত সচরাচর করি না। আব্বার খবর জানবার জন্য একটা বিশেষ দেখার অনুমতি চেয়েছিলাম আমার স্ত্রীর সাথে। আজ সাত তারিখ, কোনো খবর নাই।
১৯৪৮ সাল থেকে আজ পর্যন্ত অনেকবার এবং অনেকদিন জেল খেটেছি। এবার জনাব মোনায়েম খান যে ব্যবহার করেছেন এরূপ ব্যবহার আগে কেহই করেন নাই। রীতিমত অপমান করেছেন আমাদের। মার্শাল ল’এর সময়ও এ ব্যবহার পাই নাই। খোদা করলে বেঁচে আমি থাকব এবং মোনায়েম খান। সাহেবের সাথে নিশ্চয়ই ‘দেখা’ হবে।
আজ কয়েকদিন পর্যন্ত পাগলের উৎপাতে ঘুমাতে পারি না। যেখানে থাকি তার থেকে মাত্র ৪০ হাত দূরে ৪০ জন পাগল রাখা হয়েছে। আর আমার খাটের থেকে তিন হাত ও ছয় হাত দূরে নিউ বিশ সেলে দুইটা লোহার টিন দিয়ে ঘেরা বড় কপাট। রাতে দুই ঘণ্টা পর পর সিপাহি বদলী হয় আর বিকট শব্দ করে আমার ঘুম ভেঙে দেয়। অনেকদিন সারারাত ঘুমাতে পারি না। আবার কোনো কোনো দিন ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। এ জন্য প্রায়ই আমার মাথার যন্ত্রণা হয়। জেল কর্তৃপক্ষকে বলেছি সিপাহিরা যাতে শব্দ না করে তার চেষ্টা করেন। কিন্তু পাগল নিয়ে কি করবেন? তারা তো ভয় পায় না।
৮ই এপ্রিল–১০ই এপ্রিল ১৯৬৭
আজ জেল গেটে ১৯৬৫ সালের ২০শে মার্চ তারিখে পল্টন ময়দানের সভায় যে বক্তৃতা করেছিলাম সেই বক্তৃতার মামলার সওয়াল জবাব শেষ হয়। জনাব আবদুস সালাম খান সাহেব ও জহিরউদ্দিন সাহেব আমার পক্ষে সওয়াল জবাব করেন। সরকারি উকিল জনাব মেজবাহউদ্দিন সরকারের পক্ষে করেন। প্রায় চার ঘণ্টা চলে। ৬ দফা দাবি কেন সরকারের মেনে নেওয়া উচিত তার উপরই বক্তৃতা করেছিলাম। পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া দরকার। দেশরক্ষা শক্তিশালী করা প্রয়োজন। গত পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পূর্ব বাংলার সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের বিশেষ করে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো যোগাযোগ ছিল না। অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে হবে। আরও অনেককিছু।
আমি নাকি হিংসা, দ্বেষ ও ঘৃণা পয়দা করতে চেয়েছি পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। আমার বুকে ব্যথা, কিন্তু তা বলতে পারব না। আমার পকেট মেরে আর একজন টাকা নিয়ে যাবে, তা বলা যাবে না! আমার সম্পদ ছলে বলে কৌশলে নিয়ে যাবে বাধা দেওয়া তো দূরের কথা-বলা যাবে না। পশ্চিম পাকিস্তানে তিনটা রাজধানী করা হয়েছে যেমন করাচী, পিন্ডি এখন ইসলামাবাদ। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা বন্ধ করার টাকা চাওয়া যাবে না।
দেশরক্ষা আইনে বিচার হয়েছে। এই একই ধরনের বক্তৃতার জন্য ডজন খানেক মামলা দায়ের করা হতেছে। মামলার কিছুই নাই, আমাকে জেল দিতে পারে না। যদি নিচের দিকে জেল দিতে বাধ্য হয় তবে জজকোর্ট ও হাইকোর্টে টিকবে না। সহকর্মী অনেকে এসেছিল, দেখা হলো। কামাল এসেছিল। বলল, পরীক্ষা ভাল দিয়েছে। আব্বা খুলনায় আমার ভাইয়ের বাসায় চিকিৎসাধীনে আছেন। একটু ভালর দিকে। এখনও আরোগ্য লাভ করেন নাই। মাও সাথে আছেন।
সালাম সাহেবের সাথে আরো দুইটা মামলা ও দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হলো। পাবনায় জনসাধারণ ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের উপর চরম অত্যাচার চলছে। আওয়ামী লীগের সকল নেতা ও কর্মীদের গ্রেপ্তার করে ফেলেছে। জামিন দেওয়া হয় নাই। সালাম সাহেব নিজে গিয়েছিলেন জামিন নিতে। তাঁকে দেখা করতে দেয় নাই বন্দিদের সাথে।
১১ই এপ্রিল–১৩ই এপ্রিল ১৯৬৭
শাহ মোয়াজ্জেম হাইকোর্ট থেকে ডিপিআর আইনে মুক্তি পেলেও একটা মামলায় জামিন না পাওয়ার জন্য জেলে সাধারণ কয়েদি হয়ে কষ্ট পেতেছে। বক্তৃতার মামলায় সেশন জজ সাহেবও জামিন দেন নাই। হাইকোর্টে জামিনের জন্য আর্জি পেশ করা হয়েছে, আজ পর্যন্ত শুনানি হয় নাই। বড় দুঃখ করছিল, বলছিল সহকর্মীরা একটু চেষ্টা করলেই জামিন হয়ে যেত। পুরানা বিশ সেলে আছে। আমার সাথে মাঝে মাঝে দেখা হয়। আমি তাকে বোঝাতে চেষ্টা করি। সে নিজেও একজন এডভোকেট। তার অন্যান্য এডভোকেটদের উপর দাবি বেশি।
আমার ওয়ার্ডটার নাম সিভিল ওয়ার্ড। ৪০ হাত দূরের পুরানা ৪০ সেলকে পাগলা গারদ বলা হয়। দিনে প্রায় ৭০ জন আর রাত্রে ৩৭ জন পাগল থাকে। ৩৭টা সেলের তিনটা সেল নষ্ট হয়ে গেছে। কয়েকদিন ধরে পাগলরা রাতে খুব চিৎকার করতে শুরু করেছে। দিনের বেলায় আমি ঘুমাই না, রাতে যাতে ঘুম হয়। কিন্তু পাগলদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে যাই। রাতে মাঝে মাঝে বসেও থাকতে হয়। জেল কর্তৃপক্ষকে কি বলব? পাগল রাখবার জায়গা আর নাই।
সিভিল ওয়ার্ডের সামনে ছোট একটা মাঠ আছে। সেখানে কয়েকটা আম গাছ আছে। ফুলের বাগান করেছি। জায়গাটা ছাড়তে ইচ্ছে হয় না। আবার কোথায় দিবে ঠিক কি? রাতে যখন ঘুমাতে পারি না তখন মনে হয় আর এখানে থাকবো না। সকাল বেলা যখন ফুলের বাগানে বেড়াতে শুরু করি তখন রাতের কষ্ট ভুলে যাই। গাছতলায় চেয়ার পেতে বসে কাগজ অথবা বই পড়ি। ভোরের বাতাস আমার মন থেকে সকল দুঃখ মুছে নিয়ে যায়। আমার ঘরটার কাছের আম গাছটিতে রোজ ১০টা-১১টার সময় দুইটা হলদে পাখি আসে। ওদের খেলা আমি দেখি। ওদের আমি ভালবেসে ফেলেছি বলে মনে হয়। ১৯৫৮ সালে দুইটা হলদে পাখি আসত। তাদের চেহারা আজও আমার মনে আছে। সেই দুইটা পাখির পরিবর্তে আর দুইটা পাখি আসে। পূর্বের দুইটার চেয়ে একটু ছোট মনে হয়।