নামাজ পড়ার পরে শত শত কয়েদি আমাকে ঘিরে ফেলল। সকলের সাথে হাত মিলাতে আমার প্রায় আধা ঘণ্টা সময় লেগেছিল।
২৩শে মার্চ ১৯৬৭–৭ই এপ্রিল ১৯৬৭
আজও কারাগারের কয়েদিদের ছুটি। পাকিস্তান দিবস আজ। ১৯৪০ সালে নিখিল ভারত মুসলীম লীগ লাহোরে পাকিস্তান প্রস্তাব পাস করে। মরহুম শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক প্রস্তাব পেশ করেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান কায়েম হয়। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র অনুযায়ী এইদিনে পাকিস্তানকে রিপাবলিক ঘোষণা করা হয়। এই দিনটিকে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী শাসনতন্ত্র তৈয়ার না করার জন্য দুই পাকিস্তানে আজও ভুল বুঝাবুঝি চলছে, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানকে একটি কলোনিতে পরিণত করা হয়েছে। আমি যে ৬ দফা প্রস্তাব করেছি, ১৩ই জানুয়ারি ১৯৬৬ সালে লাহোর প্রস্তাব ভিত্তি করে, সে প্রস্তাব করার জন্য আমি ও আমার সহকর্মীরা কারাগারে বন্দি। ইত্তেফাক কাগজ ও প্রেস বাজেয়াপ্ত এবং মালিক ও সম্পাদক মানিক ভাই কারাগারে বন্দি। এই দাবির জন্যই ৭ই জুন ৭ শত লোক গ্রেপ্তার হয় এবং ১১ জন জীবন দেয় পুলিশের গুলিতে। আমি দিব্যচোখে দেখতে পারছি দাবি আদায় হবে, তবে কিছু ত্যাগের প্রয়োজন হবে। আজকাল আবার রাজনীতিবিদরা বলে থাকেন লাহোর প্রস্তাবের দাম নাই। পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন দিলে পাকিস্তান দুর্বল হবে। এর অর্থ পূর্ব পাকিস্তানের ছয় কোটি লোককে বাজার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না, যদি স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়। চিরদিন কাহাকেও শাসন করা যায় না, যতই দিন যাবে তিক্ততা আরও বাড়বে এবং তিক্ততার ভিতর দিয়ে দাবি আদায় হলে পরিণতি ভয়াবহ হবার সম্ভাবনা আছে। লাহোর প্রস্তাব আমি তুলে দিলাম : ‘Resolved that it is the considered view of this session of the All-India Muslim League that no constitutional plan would be workable in this country or acceptable to Muslims unless it is designed on the following basic principle, namely, that geographically contiguous units are demarcated into regions which should be so constituted, with such territorial readjustments as may be necessary, that the areas in which the Muslims are numerically in a majority, as in the North-Western and Eastern Zones of India, should be grouped to constitute Independent States in which constituent units shall be autonomous and sovereign.’
March 23, 1940
Moved by Late A. K. Fazlul Haque
আজ ২৫ দিন চটকল শ্রমিকরা ধর্মঘট শুরু করেছে। শান্তিপূর্ণভাবে এদের ধর্মঘট চলেছে। টঙ্গিতে গোলমাল সৃষ্টি করে আজ শত শত শ্রমিককে গ্রেপ্তার করে জেলে আনা হয়েছে। চারজনকে জেল হাসপাতালে রাখা হয়েছে। ২৫/৩০ জনকে ডিপিআর আইনে বন্দি করেছে আর সবাইকে মামলা দিয়ে হাজতে রেখেছে। চটকল শ্রমিক ফেডারেশনের সম্পাদক আবদুল মান্নানকে গ্রেপ্তার করে এনেছে। কিছুদিন পূর্বেও খাদ্য আন্দোলন করার অপরাধে ন্যাপ সহ-সভাপতি হাজী মোহাম্মদ দানেশ, সম্পাদক সৈয়দ আলতাফ হোসেন, সিরাজুল হোসেন খান ও কৃষক নেতা হাতেম আলি খানকে ধরে এনেছে। নতুন বিশ সেলে রাখা হয়েছে। ডিপিআর করে দিয়েছে, বিনা বিচারে বন্দি। জেল-জুলুম, অত্যাচার, গুলি সমানে পূর্ব বাংলায় চলেছে। আইয়ুব খান সাহেব পূর্ব পাকিস্তানে এসেছেন ২৭শে মার্চ। এপ্রিল মাসের তিন তারিখে ঢাকা থেকে রাজধানীতে ফিরে গিয়াছেন। স্বায়ত্তশাসনের অর্থ তিনি করেছেন পূর্ব বাংলাকে নাকি আলাদা করার ষড়যন্ত্র। তিনি যাহাই বলুন আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দিতেই হবে একদিন। না দিলে ফলাফল খুবই খারাপ হবে। ইতিহাস এই শিক্ষাই দিয়েছে। যখনই জনাব পূর্ব বাংলায় আসেন তখনই তাকে বিরাট অভ্যর্থনা দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হয় লাখ লাখ টাকা খরচ করে। দেখে মনে হয় তিনি বাদশা হয়ে প্রজাদের দেখতে আসেন। পশ্চিম পাকিস্তান তার দেশ আর পূর্ব বাংলা তার কলোনী। কারণ লাহোর করাচী গেলে তো গেট করা হয় না, মালা কিনে বিলি করা হয় না। ট্রাক, বাস ভরে ভাড়াটিয়া লোক নেওয়া হয় না। তিনি দুনিয়াকে দেখাতে চান তাঁর জনপ্রিয়তা। কিন্তু জনগণের ভোটে ইলেকশন হলে পূর্ব বাংলায় তার জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত হত একথা তিনি বুঝেও বুঝতে চান না।
পূর্ব বাংলার মাটিতে বিশ্বাসঘাতক অনেক পয়দা হয়েছে, আরও হবে, এদের সংখ্যাও কম না। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকদের স্থান কোথায় এরা দেখেও দেখে না! বিশেষ করে একদল বুদ্ধিজীবী যেভাবে পূর্ব বাংলার সাথে বেঈমানী করছে তা দেখে আশ্চর্য হতে হয়।
সামান্য পদের বা অর্থের লোভে পূর্ব বাংলাকে যেভাবে শোষণ করার সুযোগ দিতেছে দুনিয়ার অন্য কোথাও এটা দেখা যায় না। ছয় কোটি লোক আজ আস্তে আস্তে ভিখারি হতে চলেছে। এরা এদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের কথাও চিন্তা করে না।
কয়েকদিন পূর্বে খবর পেয়েছিলাম আব্বা খুবই অসুস্থ। আমার ভাই তাঁকে খুলনায় নিয়ে এসেছে চিকিৎসা করাতে। একটু আরোগ্যের দিকে চলেছে। আমার ভাই সরকারকে টেলিগ্রাম করেছে আমাকে কয়েক ঘণ্টার জন্য প্যারোলে ছেড়ে দিতে, কারণ আব্বা আমাকে দেখতে চান। ৮০ বৎসরের উপরে বয়স। আমাকে অত্যন্ত ভালবাসেন। আমি জানি না আমার মত এত স্নেহ অন্য কোনো ছেলে পেয়েছে কিনা! আমার কথা বলতে আমার আব্বা অন্ধ। আমরা ছয় ভাই বোেন। সকলে একদিকে, আমি একদিকে। খোদা আমাকে যথেষ্ট সহ্য শক্তি দিয়েছে, কিন্তু আমার আব্বা-মার অসুস্থতার কথা শুনলে আমি পাগল হয়ে যাই, কিছুই ভাল লাগে না। খেতেও পারি না, ঘুমাতেও পারি না। তারপর আবার কারাগারে বন্দি। আমি কারাগারে বন্দি অবস্থায় যদি আমার বাবা বা মায়ের কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তবে সহ্য করতে পারব কিনা জানি না। এখন আমার ৪৭ বত্সর বয়স, আজও আব্বা ও মায়ের গলা ধরে আমি আদর করি, আর আমাকেও তারা আদর করেন। খোদাকে ডাকা ছাড়া কি উপায় আছে।