ফিরে এলাম আমার আস্তানায়। ঘরে ঢুকলাম, তালা বন্ধ হয়ে গেল বাইরে থেকে। ভোর বেলা খুলবে।
১৮ই মার্চ, ১৯৬৭ ॥ শনিবার
জেলগেটে আমার দ্বিতীয় মামলার সওয়াল জবাব হবে। ১০ ঘটিকা হতে বসে আছি প্রস্তুত হয়ে। ১২টার সময় আমাকে জেলগেটের কোর্টে নিতে এসেছে। যেয়ে দেখি জহির সাহেব, রব সাহেব, মাহমুদুল্লা সাহেব, আবুল হোসেন, জোহা চৌধুরী প্রমুখ এডভোকেট সাহেবরা এসে বসে আছেন হাকিমের সামনে।
আমার আত্মীয়স্বজন ছাড়াও মোস্তফা আনোয়ার, চৌধুরী নিজাম, আলি হোসেন ও কর্মীরাও এসেছে। ছাত্রলীগের অন্যতম নেতা রেজাও এসেছে। ছাত্রলীগের নির্বাচন নিয়ে খুবই গোলমাল।
শুধু অনুরোধ করলাম, ‘তোমরা প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করিও। ছাত্রলীগকে ভেঙে ফেলে দিও না। সকলকে আমার সালাম দিও। ঐতিহ্যবাহী এই ছাত্র প্রতিষ্ঠান আমি গড়েছিলাম কয়েকজন নিঃস্বার্থ ছাত্রকর্মী নিয়ে। প্রত্যেকটি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে এই প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন, রাজবন্দিদের মুক্তি আন্দোলন, ব্যক্তি স্বাধীনতার আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন ও ছাত্রদের দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করে বহু জেল-জুলুম সহ্য করেছে এই কর্মীরা। পূর্ব বাংলার ছয় দফার আন্দোলন ও আওয়ামী লীগের পুরাভাগে থেকে আন্দোলন চালিয়েছে ছাত্রলীগ। এই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গোলমাল হলে আমার বুকে খুব আঘাত লাগে। তাই রেজাকে বললাম, ‘প্রতিষ্ঠান রক্ষা করিও’।
মামলা আজ আর চলবে না। কারণ সরকার পক্ষের উকিল সাহেব অসুস্থ উপস্থিত হতে পারেন নাই। কোর্টে শুনলাম আমার বিরুদ্ধে ঢাকার পাঁচটি মামলা ছাড়াও বিভিন্ন জেলায় ছয়টি মামলা দায়ের করেছে সরকার-চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, পাবনা ও যশোরে। চার্জ শীটও নাকি দিয়েছে। যাহা হউক, প্রস্তুত আছি। হাইকোর্ট থেকে শাহ মোয়াজ্জেমকে ছেড়ে দিতে হুকুম দিয়েছে। নূরে আলম সিদ্দিকী ছাত্রকর্মী, কোর্টের থেকে খবর নিয়ে এসেছে হাইকোর্টে তাকেও ছেড়ে দিতে হুকুম দিয়েছে। এডভোকেট রব সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি বললেন, হাইকোর্ট এখনও ওর মামলার রায় দেয় নাই। ছেলেটা বাইরে যাবে বলে কত খুশি হয়েছে। আট মাস মিছামিছি ওকে ডিপিআর আইনে বন্দি করে রেখেছে। ওর ধারণা একটা মামলা ঢাকা কোর্টে আছে, জামিন পেলেই বাইরে যেতে পারবে। আমাকে বলেছিল, ওর বাবা বসে আছেন ঢাকায়, মুক্তির পরে ওকে নিয়ে বাড়ি যাবেন ঈদ করতে। আগামী ২২ তারিখ ঈদ। কি বলব ওকে ভিতরে যেয়ে। ভাবলাম, ধোঁকা দেওয়া ভাল হবে না। বলেই দেই সত্য কথা। জেলের ভিতরে যেয়ে ওকে খবর দিলাম, তুমি ভুল শুনেছ, তোমার মামলার রায় হয় নাই, ঈদের পরে হবে। মুখটা ওর কালো হয়ে গেল। মনে হলো খুবই আঘাত পেয়েছে। দিন কেটে গেল। রাত্র আটটায় হঠাৎ শুনতে পেলাম কে যেন আমাকে ডাকছে, ‘মুজিব ভাই’, ‘মুজিব ভাই’ বলে। জানলা দিয়ে চেয়ে দেখি শাহ মোয়াজ্জেম। বললাম, কি ব্যাপার তুমি এখানে? ‘ডিপিআর থেকে মুক্তি পেয়েছি এখন-বিচারাধীন আসামি তাই ১০ সেল থেকে আমাকে নিয়ে এসেছে। ডিপিআরদের কাছে আমাকে রাখবে না। জমাদার সাহেবকে বললাম, কোথায় রাখবেন? বলল, রাতে আর কোথায় রাখব ২০ সেলে আমার কাছাকাছি। বললাম, কাপড় চোপড় বিছানা আছে?’ বলল, যা আছে চলে যাবে, খাবারও ১০ সেল থেকে রাতের জন্য আসবে। আমার সাথে কথা বলা নিষেধ, তবু রাস্তা যখন পড়েছে আমার ঘরের কাছ দিয়ে তখন মুখে হাত দিয়ে তো বন্ধ করতে পারে না। বললাম, আর চিন্তা কি! মামলা দুইটি আছে, জামিন পেয়েছ, আর দুই একদিন দেরি হতে পারে।
২২শে মার্চ ১৯৬৭ ॥ বুধবার
আজ কোরবানির ঈদ। গত ঈদেও জেলে ছিলাম। এবারও জেলে। বন্দি জীবনে ঈদ উদযাপন করা একটি মর্মান্তিক ঘটনা বলা চলে। বার বার আপনজন বন্ধু-বান্ধব, ছেলেমেয়ে, পিতামাতার কথা মনে পড়ে।
ইচ্ছা ছিল না নামাজে যাই। কিইবা হবে যেয়ে, কয়েদিদের কি নামাজ হয়। আমি তো একলা থাকি। আমার সাথে কোনো রাজনৈতিক বন্দিকে থাকতে দেয় না। একাকী কি ঈদ উদযাপন করা যায়? জেলার সাহেব নামাজ বন্ধ করে রেখে আমাকে নিতে আসেন। তাই যেতে বাধ্য হলাম।
মোশতাককে আনা হয়েছে রাজশাহী জেল হতে গত মে মাসে। ঢাকা থেকে পাবনা জেলে বদলি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাজউদ্দীন এখনও ময়মনসিংহ জেলে আটক আছে। মোশতাক, জালাল, মোমিন সাহেব, ওবায়দুর রহমান, সিরাজ, সুলতান নামাজ পড়তে এসেছে ১০ সেল থেকে। মিজানুর রহমান ও নারায়ণগঞ্জের মহিউদ্দিন নামাজে আসে নাই। পুরানা হাজত থেকে মণি, হালিম আরও অনেকে এসেছে।
১/২ ওয়ার্ড থেকে রুহুল আমিন, প্রতাপউদ্দিন সাহেব, আবদুস সালাম খান ও অনেকে এসেছে। সকলের সাথেই দেখা হয়ে গেল। মোশতাকের শরীর খারাপ হয়ে গেছে। ১০ সেল থেকে নূরুল ইসলাম আমার সাথেই নামাজে যায়। তাকে সিলেট জেল থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। তার টিবি ভাল হয়ে গিয়েছে।
শাহ মোয়াজ্জেম হাইকোর্ট থেকে হেবিয়াস কর্পাস করে মুক্তি পেয়ে হাজতে আছে। তার বিরুদ্ধে দুইটা মামলা আছে। একটি জামিন পেয়েছে আর একটি জজকোর্ট থেকে জামিন পায় নাই। এখন হাইকোর্টে যেতে হবে। শাহ মোয়াজ্জেম একজন এডভোকেট, তার জামিন না দেওয়ার কি কারণ বুঝতে পারলাম না। বাড়ি থেকে খাবার পাঠাইয়াছিল। আমি শাহ মোয়াজ্জেম, নূরুল ইসলাম, নূরে আলম সিদ্দিকীকে নিয়ে খেলাম। হ্যাঁ খেতে হবে। রেণু বোধ হয় ভোর রাত থেকেই পাক করেছে, না হলে কি করে ১২টার মধ্যে পাঠাল!