প্রথম ভাষা আন্দোলন শুরু হয় ১১ই মার্চ ১৯৪৮ সালে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (এখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ) ও তমদুন মজলিসের নেতৃত্বে। ঐদিন ১০টায় আমি, জনাব শামসুল হক সাহেব সহ প্রায় ৭৫ জন ছাত্র গ্রেপ্তার হই এবং আব্দুল ওয়াদুদ-সহ অনেকেই ভীষণভাবে আহত হয়ে গ্রেপ্তার হয়।
১৫ই মার্চ জনাব নাজিমুদ্দীন (তখন পূর্ব পাকিস্তানের চীফ মিনিস্টার ছিলেন) সংগ্রাম পরিষদের সাথে আলাপ করে ঘোষণা করলেন, পূর্ব পাকিস্তান আইন সভা হতে প্রস্তাব পাশ করাইবেন বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে। সকল বন্দিকে মুক্তি দিবেন এবং নিজেই পুলিশের অত্যাচারের তদন্ত করবেন। ঐ দিন সন্ধ্যায় আমরা মুক্তি পাই।
১৬ই মার্চ আবার বিশ্ববিদ্যালয় আমতলায় সভা হয়, আমি সেই সভায় সভাপতিত্ব করি। আবার বিকালে আইন সভার সামনে লাঠি চার্জ হয় ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হয়। প্রতিবাদের বিষয় ছিল, নাজিমুদ্দীন সাহেবের তদন্ত চাই না, জুডিশিয়াল তদন্ত করতে হবে। ২১শে মার্চ বা দুই একদিন পরে কায়েদে আজম প্রথম ঢাকায় আসবেন। সেই জন্য আন্দোলন বন্ধ করা হলো। আমরা অভ্যর্থনা দেওয়ার বন্দোবস্ত করলাম। তিনি এসে ঘোষণা করলেন, উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে। ছাত্ররা তার সামনেই কনভোকেশনে প্রতিবাদ করল। রেসকোর্স ময়দানেও প্রতিবাদ উঠল। তিনি হঠাৎ চুপ করে গেলেন। যতদিন বেঁচে ছিলেন এরপরে কোনোদিন ভাষার ব্যাপারে কোনো কথা বলেন নাই। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ প্রত্যেক বৎসর ১১ই মার্চকে ভাষা দিবস’ পালন করেছে। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলীম লীগ (এখন আওয়ামী লীগ) এই একই দিনে ভাষা দিবস পালন করেছে। ভাষা আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের দান সবচেয়ে বেশি। পরে ইয়ুথ লীগও আন্দোলনে শরীক হয়েছে।
১৯৪৮ সালের ১৫ই মার্চ তারিখে খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে যে ওয়াদা আইনসভায় করেছিলেন, ১৯৫২ সালে ২৬শে জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে তা ভেঙ্গে পল্টনের জনসভায় ঘোষণা করলেন, উর্দুই রাষ্ট্রভাষা হবে। তখন প্রতিবাদের ঝড় উঠলো। আমি তখন বন্দি অবস্থায় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। রাত্রের অন্ধকারে মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের সহায়তায় নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ করে ২১শে ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদের দিন স্থির করা হয়। কারণ ২১শে থেকে বাজেট সেশন শুরু হবে। আমি ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন শুরু করব মুক্তির জন্য। কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, মোল্লা জালালউদ্দিন, মোহাম্মদ তোয়াহা, নঈমুদ্দীন, খালেক নেওয়াজ, আজিজ আহম্মদ, আবদুল ওয়াদুদ ও আরো অনেকে গোপনে গভীর রাতে আমার সঙ্গে দেখা করত।
তখন জনাব নূরুল আমীন মুখ্যমন্ত্রী। ২১শে ফেব্রুয়ারি গুলি হলো। আমার ভাইরা জীবন দিয়ে বাংলা ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত করল।
এইদিন আমাদের কাছে পবিত্র দিন। ১৯৫৫ সালে নূতন কেন্দ্রীয় আইন সভায় আওয়ামী লীগ ১২ জন সদস্য নিয়ে ঢুকল এবং তাদের সংগ্রামের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা বাধ্য হলো ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে বাংলা ও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে। আওয়ামী লীগ যখন ১৯৫৬ সালে ক্ষমতায় বসল তখন ২১শে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ও সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করল। ১৯৫৭-৫৮ সালে এই দিবসটা সরকারিভাবেও পালন করা হয়েছে। শহীদ মিনার করার জন্য পরিকল্পনা করে বাজেটে টাকা ধরে কাজ শুরু হয়েছিল কিন্তু ১৯৫৮ সালে মার্শাল ল জারি হওয়ার পরে এই দিনটি সরকারি ছুটির তালিকা থেকে বাদ পড়ল, আর মিনারটা চুনকাম করেই শেষ করে দেওয়া হলো।
আমি কারাগারের এই ছোট্ট ঘরটি থেকে আমার আন্তরিক মোবারকবাদ জানাই বাংলার যুব সমাজ ও জনসাধারণকে, আর শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করি।
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি সৈয়দ মজহারুল হক (বাকী) জামিন পেয়ে এতদিন জেলের বাহিরে যেতে পারে নাই। আজ সকালে তাকে কোর্টে পাঠাইয়া দিয়েছে। জেল হাজত থেকে মুক্তি পেয়ে শহীদ দিবস পালন করছে।
২৫শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৭ ॥ শনিবার
আজ আমার ১১টি মামলার একটা মামলা জেলগেটে, যার বিচার চলছে জনাব আফসারউদ্দিন সাহেবের কোর্টে; তার আরগুমেন্ট হওয়ার কথা ছিল কিন্তু হতে পারে নাই। কারণ আমার এডভোকেট জনাব সালাম খান সাহেব এবং জহিরুদ্দিন সাহেব উপস্থিত হতে পারেন নাই। জনাব মাহমুদুল্লা সাহেব হাজির হয়ে দরখাস্ত করেছিলেন, আমি উপস্থিত ছিলাম। ডিএসপি সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার আর একটি মামলা স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে হবার কথা, কখন শুরু হবে? তিনি বললেন, সরকার নতুন এডিএম নিযুক্ত করেছেন, শীঘ্রই জেলগেটেই শুরু হবে। আমার এডভোকেট মাহমুদুল্লা সাহেব নোটিশ পেয়েছেন আমাকে হাজির করাবার জন্য। তিনি বলেছেন, আসামি কারাগারে সরকারের তত্ত্বাবধানে আছেন। সরকার ইচ্ছা করলেই হাজির করতে পারেন।
আফসারউদ্দিন সাহেবের কোর্টে মামলার দিন ঠিক হয়েছে মার্চ মাসের ১৮ তারিখে। যাহা হউক, এই মামলা দুই মাসের মধ্যেই যা হয় একটা হয়ে যাবে। আবার নতুন মামলা শুরু হবে। আমি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে বললাম, চিন্তা করি না; ১১টা মামলা, চিন্তা করে কি হবে? গা ভাসাইয়া দিয়াছি। ‘সাগরে শয়ন যার শিশিরে কি ভয় তার।‘
ভেবেছিলাম বড় ছেলেটি আসবে, বাসার খবর পাব। বোধ হয় আসতে পারে নাই। এ সপ্তাহে বাড়ির থেকে দেখাও’ আসে নাই। বোধ হয় অনুমতি পায় নাই।