যাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড খাটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে তাদেরই এই ‘পাওয়ার দেয়া হয়। সকলকেই নাইটগার্ড করা বা কালা পাগড়ি দেয়া হয় না। যারা জেলের মধ্যে ভালভাবে থেকেছে, স্বভাব চরিত্রের পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে করা হয়, তাদেরই নাইটগার্ড করা হয়। কালা পাগড়ি ও নাইটগার্ডদের বাইরে ডিউটি দেয়া হয়। ‘মেট’ পাহারা ভেতরে পাহারা দেয়। যেখানে কয়েদিদের বন্ধ করে রাখা হয় সেখানে পাঁচজন করে মেট পাহারা থাকে। তারা দুই ঘণ্টা করে রাতে পাহারা দেয়। বাইরের থেকে সিপাহিরা জিজ্ঞাসা করে ভেতর থেকে উত্তর দেয়। প্রত্যেকটা ওয়ার্ডে নাম্বার আছে। সিপাহিরা জিজ্ঞাসা করে আর নম্বর বলে ভেতর থেকে উত্তর দিতে হয়।
যেমন একজন সিপাহি বলল, “পাঁচ নাম্বার সাথে সাথে ভেতর থেকে বলতে হবে, ঠিক আছে, পঞ্চাশ জানালা বাড়ি ঠিক। মানে হলো কয়েদি ৫০ জন, আর বাড়ি ঠিক আছে। আবার জানালাও ঠিক আছে। এমনি এক নম্বর, দুই নম্বর, তিন নম্বর—এমনি করে রাতভর সিপাহিরা ডাকতে থাকে, যার উত্তর কয়েদি পাহারা ও মেটেরা ভিতর থেকে দিতে থাকে। রাতে দুইঘণ্টা পর পর সিপাহি বদলি হয়ে যখন নতুন সিপাহি আসে, তারা এসে তালা ভালভাবে চারিদিক পরীক্ষা করে দেখে, পূর্বের সিপাহির কাছ থেকে কাজ বুঝে নিতে হয়। সিপাহি বদলির সাথে সাথে আবার ভিতরে পাহারাও বদলি হয়ে পূর্বের পাহারার থেকে কাজ বুঝে নেয়।
কয়েদিরাই কয়েদিদের চালনা করে ও কাজ করায়। কাজ বুঝিয়ে দিতে হয় আবার কাজ বুঝে নিতে হয়। কয়েদিদের ওপর যে অত্যাচার হয় বা মারপিট হয়, তাও কয়েদিরাই করে। ইংরেজের কায়দা, কাঁটা দিয়েই কাঁটা তোলা হয়। একটা সত্য ঘটনা না লিখে পারছি না। ঘটনাটা ঢাকা জেলে ঘটেছিল। একজন কয়েদির কয়েকটা চুরি মামলায় কয়েক বছর জেল হয়। চোর বলে গ্রামের লোক ওর বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয় এবং জেল দেওয়াইয়া দেয়। গ্রামের লোক কেউই ওকে দেখতে পারতো না। যারা জেল খাটার পরে পাহারা হয় এবং পরে কনভিক্ট ওভারসিয়ার হয়—যাকে মেট বলা হয়, তারা বেল্ট পরতে পারে। মেট হয়ে যখন কয়েকজন কয়েদির ভার পড়ল ওর ওপরে কাজ করাবার জন্য তখন ওর কথামতো তাদের চলতে হতো। তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে সে তার স্ত্রীর কাছে একটা চিঠি লিখলো। তাতে লিখেছে, ‘গ্রামে আমার কথা কেহই শুনতো না, আমাকে সকলে ঘৃণা করত, কিন্তু খোদার মেহেরবানিতে জেলখানায় আমার এত প্রতিপত্তি হয়েছে যে, আমার কথামতো কতগুলি লোককে কাজ করতে হয়। বসতে বললে বসতে হয়, দাঁড়াতে বললে দাঁড়াতে হয়, কথা না শুনলে কোমরের বেল্ট খুলে খুব মার দেই। কারও প্রতিবাদ করার ক্ষমতা নাই। আল্লাহ আমাকে খুব সম্মান দিয়েছে। এত বড়ো সম্মান সকলের কিসমতে হয় না। গ্রামের লোক আমাকে চোর বললে কি হবে, জেলে আমি একটা মাতুব্বার শ্রেণীর লোক। চুরি না করলে আর জেলে না আসলে এ সম্মান আমাকে কেউই দিত না। তুমি ভেবো না। এখানে খুব সম্মানের সাথে আছি।’ সত্যিই এত বড় সম্মান ও কোনোদিন আশা করতে পারে নাই।
কয়েদিরা চিঠি যখন পাঠায় তখন পরীক্ষা করে দেখা হয় জেল অফিসে। যখন এই চিঠি পরীক্ষা করার জন্য খোলা হলো তখন তো সকলে চিঠি পড়ে হাসতে হাসতে সারা। চিঠি জেলার সাহেব, সুপার সাহেব সকলেই পড়লেন। পরের দিন তাকে হাজির করে তার বেল্টটা কেড়ে নেয়া হলো। তার মাতব্বরী শেষ। এই গল্পটা কোনো এক জেলার সাহেব আমাকে বলেছিলেন।
জেলে কতগুলি কথা ব্যবহার হয় যা বাইরের লোক সহজে বুঝতে পারবে না। আমি যখন প্রথম জেলে আসি তার পরদিন সকালে একজন কয়েদি ‘পাহারা এসে আমার ও আমার সাথী কয়েকজনকে বলল আপনাদের কেসটাকোলে যেতে হবে। আমরা তো ভেবেই অস্থির। বাবা ‘কেসটাকোল’ কি জিনিস? কোথায় যেতে হবে? বললো ওখানে কেসটাকোল হয়। আমরা একে অন্যের মুখের দিকে চাই। বললাম চলো, আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো এক জায়গায়। সেখানে জেলসুপার সাহেব এসে নতুন কয়েদিদের সকল কিছু জেনে টিকিটে লিখে নেয়। কয়েদিরা অন্যায় করলে বিচার হয়। আমরা যখন পৌছলাম, তখন সুপার সাহেব বললেন, আপনারা চলে যান আপনাদের রুমে। আপনাদের ওজন, নামধাম আপনাদের ওখানে যেয়ে লিখে আনবে। সিপাহি একজন আমাদের পৌঁছাইয়া দিল।
আমাদের সাথে কয়েকজন ডিভিশন কয়েদি ছিল তার মধ্যে শাহাবুদ্দিনকে আমি জানতাম, বাড়ি সিলেট। সিলেট গণভোটে কাজ করত, মুসলিম লীগের একজন নামকরা কর্মী ছিল। বিখ্যাত কালাবাড়ী খুন মামলায় ২০ বছরের সাজা হয়েছে। শাহাবুদ্দিনের নাম ছিল পি এম শাহাবুদ্দিন। সকলে ঠাট্টা করে বলতো, পলেটিক্যাল মারদাঙ্গার শাহাবুদ্দিন। জেলখানায় অনেকের পিছনে সে লাগতো, কারও ভাল দেখতে পারতো না। তবে লেখাপড়া জানতো। কয়েদিদের কাজ করে দিতে বলে কেহ কিছু বলতো না। শাহাবুদ্দিনকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কেসটাকোল কিরে ভাই? ওতো হেসেই অস্থির। আমাকে বলল দেখেনতো, ইংরেজি ডিকশনারিতে আছে নাকি? আমি বললাম জীবনে তো শুনি নাই, থাকতেও পারে। ইংরেজি তো খুব ভাল জানি না। পুরনো ডিভিশন কয়েদিরা সকলেই হাসে। আমি তো আহাম্মক বনে গেলাম, ব্যাপার কী? পরে হাসতে হাসতে বললো, কেস ফাইল, কেস টেবিল, ‘কেসটাকোল’ না। কয়েদিরা একে এই নাম বলে ডাকে। কেস টেবিলে বিচার হয়। কয়েদিরা অন্যায় করলে শাস্তি পায়। কয়েদিদের অনুরোধ, দাবির কথা শোনে। চিঠিপত্র লেখে। নিজেকে আমি আহাম্মক মনে করেছিলাম। কেস টেবিল থেকে কেসটাকোল’ নতুন একটা ইংরেজি শব্দ কয়েদিরা জন্ম দিয়েছে। এরকম অনেক শব্দ ও নাম জেলখানায় আছে। পরে লিখব। সেন্ট্রাল জেলে অনেক রকম ডিপার্টমেন্ট আছে। কয়েদিদের ভাগ করে দেয়া হয়। এই ডিপার্টমেন্টকে ‘দফা বলা হয়।