তাঁর জীবনের এত কষ্ট ও ত্যাগের ফসল আজ স্বাধীন বাংলাদেশ। এ ডায়েরি পড়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ তাদের স্বাধীনতার উৎস খুঁজে পাবে।
আমার মায়ের প্রেরণা ও অনুরোধে আব্বা লিখতে শুরু করেন। যতবার জেলে গেছেন আমার মা খাতা কিনে জেলে পৌঁছে দিতেন, আবার যখন মুক্তি পেতেন তখন খাতাগুলি সংগ্রহ করে নিজে সযত্নে রেখে দিতেন। তাঁর এই দূরদর্শী চিন্তা যদি না থাকত তাহলে এই মূল্যবান লেখা আমরা জাতির কাছে তুলে দিতে পারতাম না। বার বার মায়ের কথাই মনে পড়ছে।
শেখ হাসিনা
২৫শে জানুয়ারি ২০১৭
১. জেলে যারা যায় নাই
জেলে যারা যায় নাই, জেল যারা খাটে নাই—তারা জানে না জেল কি জিনিস। বাইরে থেকে মানুষের যে ধারণা জেল সম্বন্ধে ভিতরে তার একদম উল্টা। জনসাধারণ মনে করে চারদিকে দেওয়াল দিয়ে ঘেরা, ভিতরে সমস্ত কয়েদি এক সাথে থাকে, তাহা নয়। জেলের ভিতর অনেক ছোট ছোট জেল আছে।
কারাগার যার একটা আলাদা দুনিয়া। এখানে আইনের বইতে যত রকম শাস্তি আছে সকল রকম শাস্তিপ্রাপ্ত লোকই পাওয়া যায়। খুনি, ডাকাত, চোর, বদমায়েশ, পাগল—নানা রকম লোক এক জায়গায় থাকে। রাজবন্দিও আছে। আর আছে হাজতি—যাদের বিচার হয় নাই বা হতেছে, এখনও জামিন পায় নাই। এই বিচিত্র দুনিয়ায় গেলে মানুষ বুঝতে পারে কত রকম লোক দুনিয়ায় আছে। বেশিদিন না থাকলে বোঝা যায় না। তিন রকম জেল আছে। কেন্দ্রীয় কারাগার, জেলা জেল, আর সাবজেল—যেগুলি মহকুমায় আছে। জেলখানায় মানুষ, মানুষ থাকে না—মেশিন হয়ে যায়। অনেক দোষী লোক আছে; আর অনেক নির্দোষ লোকও সাজা পেয়ে আজীবন কারাদণ্ড ভোগ করছে। সাবজেল দুইতিন মাসের সাজাপ্রাপ্ত লোক ছাড়া রাখে না। ডিস্ট্রিক্ট জেলে পাঠিয়ে দেয়। প্রায় তিন বছরের উপর জেল হলে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠাইয়া দেয়।
আমি পাঁচবার জেলে যেতে বাধ্য হয়েছি। রাজবন্দি হিসেবে জেল খেটেছি, সশ্রম কারাদণ্ডও ভোগ করতে হয়েছে। আবার হাজতি হিসেবেও জেল খাটতে হয়েছে। তাই সকল রকম কয়েদির অবস্থা নিজের জীবন দিয়ে বুঝতে পেরেছি। আমার জীবনে কি ঘটেছে তা লিখতে চাই না, তবে জেলে কয়েদিরা কিভাবে তাদের দিন কাটায়, সেইটাই আলোচনা করব। পূর্বেই বলেছি, ‘জেলের ভিতর অনেক ছোট ছোট জেল আছে। জেলের কাজ কয়েদিরাই বেশি করে; অফিসারদের সাহায্য করে, আলাদা আলাদা এরিয়া আছে। হাজতিরা এক জায়গায় থাকে। সেখান থেকে তারা বের হতে পারে না। রাজবন্দিরা আলাদা আলাদা জায়গায় থাকে। সেখান থেকে তারা বের হতে পারে না। কয়েদিদের জন্য আলাদা জায়গা আছে, ছোট ছোট দেয়াল দিয়ে ঘেরা। তার মধ্যেই থাকতে হয়। আর একটা এরিয়া আছে যাকে বলা হয় সেল এরিয়া। যেখানে জেলের মধ্যে অন্যায় করলে সাজা দিয়ে সেলে বন্ধ করে রাখা হয়। আবার অনেক সেলে একরারীদের রাখা হয়। সেল অনেক রকমের আছে—পরে আলোচনা করব।
কয়েদিদের গুনতি দিতে দিতে অবস্থা কাহিল হয়ে যায়। সকালে একবার গণনা করা হয়, লাইন বেঁধে বসিয়ে গণনা করে। জমাদাররা যখন সকালে দরজা খোলে তখন একবার, আবার দরজা খোলার পরে একবার, ১১টার সময় একবার, সাড়ে ১২টায় একবার, বিকালে একবার; আবার সন্ধ্যায় তালাবন্ধ করার সময় একবার। প্রত্যেকবারই কয়েদিদের জোড়া জোড়া করে বসতে হয়। কয়েদিদের জন্য আলাদা আলাদা ওয়ার্ড আছে। কোনো ওয়ার্ডে একশত, কোনোটায় পঞ্চাশ, কোনোটায় পঁচিশ, আবার এক এক সেলে এক একজন, কোনো সেলে তিনজন, চারজন, পাঁচজনকেও বন্ধ করা হয়। তবে এক সেলে কোনোদিন দুইজনকে রাখা হয় না। কারণ, দুইজন থাকলে ব্যভিচার করতে পারে, আর করেও থাকে।
জেলের ভিতর হাসপাতাল আছে, ডাক্তারও আছে। অসুস্থ হলে চিকিৎসাও পায়। কাজ করতে হয়। যার যা কাজ ভাগ করে দেওয়া হয়। যারা লেখাপড়া জানে, তারা অফিসে রাইটারের কাজ করে। কেহ বাগানে, কেহ গুদামে, কেহ ফ্যাক্টরিতে, কেহ সুতা কাটে, কেহ পাক করে, কেহ ঝাড় দেয়, আর কেহ মেথরের কাজও করে। যত রকম কাজ সবই কয়েদিদের করতে হয়। সন্ধ্যার পরে কেউই বাইরে থাকতে পারে না। সন্ধ্যায় সকলকেই তালা বন্ধ করে দেওয়া হয় বাইরে থেকে। ভিতরেই পায়খানা-প্রস্রাবখানা আছে। সন্ধ্যার পূর্বেই লাইন ধরে বসে খানা শেষ করতে হয়। তালা বন্ধ করে সিপাহিরা বাইরে পাহারা দেয়। ভিতরে থাকে কয়েদিরা। কয়েদিরা যত দিন জেলে থাকে—সন্ধ্যার পরে অন্ধকার হলো, কি চাঁদের আলো, এ খবর খুব কম রাখে।
কয়েদিদের ভিতর আবার প্রমোশনও হয়। কালো পাগড়ি নাইটগার্ড, গেট-পাহারা ইত্যাদি। যে সাজা তাদের দেয়া হয় তার অর্ধেক জেলখাটা হয়ে গেলে তাদের পাহারার কাজ দেয়া হয়। পাহারাদের কালো ব্যাচ পরতে হয়। এরা দরজায় দরজায়, দেয়ালে দেয়ালে, পাহারা দেয়। আবার কেউ কয়েকজন কয়েদির মালিক হয়, এই কয়েদিদের কাজ করায়। সেলে ব্যাজের ‘পাহারা’ জেলের সকল জায়গায় যেতে পারে। কাউকে ডাকতে হলে, কোনো কয়েদিকে আনার দরকার হলে জমাদার সিপাহিরা এদের পাঠায়। এদের উপর থাকে, কিনভিক্ট ওভারসিয়ার’-যাদের ‘মেট’ বলা হয়, এদের কোমরে চামড়ার বেল্ট থাকে। এরাও ‘পাহারা’দের মতো কাজ করায়। কয়েকজন কয়েদি-তাদের উপর যে যার মেট থাকে—এদের দেখাশোনা করে। তিনভাগের দুইভাগ সাজা খাটা হলে ‘মেট’ হতে পারে। এর উপর নাইটগার্ড করা হয়। এরা কোমরে বেল্ট ও সিপাহিদের মতো বাঁশি পায়। দরকার হলে এরা বাঁশি বাজাতে পারে এবং পাগলা ঘণ্টা দেওয়াতে পারে। যারা রাতে সিপাহিদের সাথে ডিউটি দেয় তাদের খাট-মশারি-বালিশ দেয়া হয়। তারা জেলের ভিতরে সকল জায়গায় ঘুরতে পারে। এর উপরে থাকে কালা পাগড়ি, তাদের কালা পাগড়ি পরতে হয়, এরা কোমরে বেল্ট ও বাঁশি পায়। এদের ক্ষমতা প্রায়ই সিপাহিদের সমান। এরা এক একটা এরিয়ার চার্জে থাকে এবং সেপাই জমাদারদের সাহায্য করে।