১৫ই জুন ১৯৬৬ ॥ বুধবার
আজ আমার ছেলেমেয়েরা আসতেও পারে, কারণ ১৫ দিন হয়ে যায়। আমিও একটা দরখাস্ত করেছি, মায়ের অবস্থা জানবার জন্য তাড়াতাড়ি আমার স্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করতে চাই। অনুমতি না আসা পর্যন্ত তো সঠিক খবর পাব না। চিন্তা না করতে চাইলেও চিন্তা আসে।
আমার বাবুর্চি একটা কবুতরের বাচ্চা পালে। তাকে আদর করে কোলে নিয়ে বেড়াই। এখনও কাপড়ের ছোট্ট থলিয়া বানাইয়া তার ভিতর ভিজা চাউল দিয়ে তারপর একটা ফুটো করে খাবার খাওয়াতে হয়। এখন একটু একটু উড়তে শিখেছে। চুপচাপ কিছু সময় তারপর দেয় ছুট। একেবারে পাকের ঘরের দিকে ছুটলো। মানে আমাকে আর ধরতে হলো না। বাচ্চাটা বাবুর্চিকে দেখলে মনে করে সেই বোধ হয় তার সব কিছু।
আজ বাইরে অনেক সময় বসে রইলাম। অনেক কথা মনে আসে! নানা বিষয়ের অনেক কথা। বরিশালের মি. চিত্তসূতার ও পাবনার রণেশ মৈত্র আমার সামনেই বিশ সেলে আছেন। আগে মাঝে মাঝে দরজা খুলতো, আজ থেকে কড়া হুকুম, দরজা খোলাই হবে না।
কি ভীষণ দুরবস্থা! যদিও ভিতরে সামান্য জায়গা আছে তবুও মন দেখতে চায় বাহিরটাকে। তাই মনের উপর এই ভীষণ অত্যাচার। বন্দি লোকগুলি অন্ধ হয়ে যাবে, না হয় স্বাস্থ্য একবারে ভেঙে যাবে-বাইরে যেয়ে যেন আর কোনো কাজ করতে না পারে-এটাই স্বৈরাচারী সরকারের উদ্দেশ্য। আমি দূর থেকে অনেকক্ষণ দেখলাম, দরজা খোলা হলো না। পরে খবর নিয়ে জানলাম কড়া হুকুম, জমাদার সিপাহির চাকরি থাকবে না। আমার সাথে যেন কোনোমতে কথা না বলতে পারে। কথা তো আমরা বলতেও পারি না। দরজা খুললে দরজার কাছে দাঁড়ালে দূর থেকে একে অন্যকে শুভেচ্ছা জানাতে পারি। এর বেশি তো আর না। আমার অবস্থা হয়েছে, পর্দানসিন জানানা’র মতো, কেউ আমাকে দেখতেও পারবে না, আমিও কাউকে দেখতে পারব না। কেউ কথা বলতে পারবে না, আমিও পারব না।
আমার উপর সরকারের কড়া নজর। জেলের ডি.আই.জি. সাহেবকে বলেছি, জেলের আইন ভঙ্গ করে আমাকে একাকী রেখেছেন। জেল আইনে কাহাকেও বিনা অপরাধে, Solitary Confinement’—রাখার নিয়ম নাই। এটা আইন বিরুদ্ধ, তবুও আপনারা আইন ভঙ্গ করে চলেছেন। উপরের হুকুম’ বলে আপনারা চুপ করে থাকেন। আমাকে হুকুম দেখান, আমি আপত্তি করব না। একাকী থাকবো যত কষ্টই হয়। ডিআইজি সাহেব বললেন, আমি উপরের সাথে আলাপ করে আপনাকে জানাবো। কি হবে সে আমি জানি, তবে পরে আমাকে দোষ দিতে পারবেন না। আমি বিনা প্রতিবাদে অত্যাচার সহ্য করার লোক নই।
সময় কাটছে না, খবরের কাগজ পাঠাতে দেরি করছে। বসে আছি গেটের দিকে চেয়ে, কখন আসে, ১২টা, ১টা, ২টা বেজে গেল-কাগজ এল না। তখন বাধ্য হয়ে ডিউটি জমাদার সাহেবকে বললাম, কি অন্যায়, ২টা বেজে গেল, আর এখনও খবরের কাগজ জেল অফিস থেকে আসছে না। মেহেরবানী করে খবর নেন কাগজ দিবে কি দিবে না? যদি একেবারেই না দেয় সে অন্য কথা। আমরা বুঝতে পারি রাজা বাদশার আমলের বন্দিখানায় আছি। সকাল ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে হকাররা কাগজ দিয়ে যায়, আর একটা দস্তখত করে ভিতরে পাঠাতে সময় লাগে পাঁচ ঘণ্টা, ছয় ঘণ্টা। এর কোনো অর্থ বুঝতে আমার সত্যই কষ্ট হয়। ইচ্ছা করলেই ১০টার মধ্যে কাগজ আমাদের দিতে পারে। বন্দির তো কোনো মতামত নাই। আর এদের ইচ্ছা বলেও কোনো পদার্থ নাই। কাগজ দেখে মনে হলো, ১৪ তারিখে আমাদের মামলা শুরু হয় নাই হাইকোর্টে।
ইংল্যান্ড থেকে আমাকে এক তারবার্তা পাঠাইয়াছে ‘প্রবাসী বাঙালীরা সমগ্র বৃটেনে শহীদ দিবস পালন করবে ১৭ ও ১৮ জুন। ব্রিটেনস্থ পাকিস্তানিদের প্রতিষ্ঠান প্রগতি ফ্রন্টের জেনারেল সেক্রেটারি এস এম হোসেন বৃটেনের সকল পাকিস্তানি নাগরিক ও পাকিস্তানি সংস্থাসমূহের প্রতি সাফল্যজনকভাবে শহিদ দিবস উদ্যাপনের দ্বারা অত্যাচারী জালেমশাহীর পাশবিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপনের আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের অত্যাচার, নির্যাতন, শোষণ, দুর্নীতি, অবিচার ও অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপের অবসানের জন্য আমাদের সংঘবদ্ধভাবে আওয়াজ তুলিতে হইবে।
এই সংবাদ দৈনিক আজাদ কাগজে ৭ই জুন ৩১ জ্যৈষ্ঠ তারিখে বাহির হয়েছে।
বৃটেনস্থ পাকিস্তানিদের পক্ষ হইতে জনাব হোসেন ও পাকিস্তান সমিতির প্রেসিডেন্ট জনাব আফরোজ বখত দেশ ও জনগণের জন্য সাহসিকতাপূর্ণ সংগ্রাম পরিচালনা ও দুঃখ ভোগের জন্য পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি অভিনন্দন জানাইয়া এক তারবার্তা প্রেরণ করিয়াছেন।
তারবার্তায় তাহারা বলেন, “প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আপনি যে সংগ্রাম চালাইয়া যাইতেছেন তাহাতে আমাদের সমর্থন রহিয়াছে। এই আন্দোলনকে নৈতিক, আর্থিক ও সামাজিক প্রভৃতি সর্বপ্রকার সাহায্য দানের জন্য আমরা প্রস্তুত রহিয়াছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন যে আমাদের প্রাণদানকারী ভ্রাতাদের রক্তপাত ব্যর্থ যাইবে না। আমরা তাহাদের জন্য ও একই উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কাজ করিয়া যাইতেছি—জনসাধারণের প্রতি ইহাই আমাদের বাণী।
জাতীয় পরিষদের ভিতর ও বাহিরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম পরিচালনার উদ্দেশ্যে তারবার্তায় জনাব নূরুল আমীনের প্রতিও অভিনন্দন জ্ঞাপন করা হয়।
তারবার্তায় পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক রক্তপাতের তীব্র নিন্দা করা হয় এবং বলা হয় যে ইহার ফলে পাকিস্তানের ইতিহাসে সর্বাধিক কলঙ্কময় অধ্যায়ের সৃষ্টি হইল।