দেখেই খুশি হলাম যে আমি ও আমার সহকর্মীরা অনেকেই জেলে আটক থাকা অবস্থায়ও আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীরা শান্তিপূর্ণ গণআন্দোলন চালাইয়া যাওয়ার সঙ্কল্প করিয়াছে। রক্ত এরা বৃথা যেতে দিবে না। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক্টিং সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের। তাঁর সভাপতিত্বে ১১ ঘন্টা ওয়ার্কিং কমিটির সভা হয়েছে। মিজানুর রহমান চৌধুরী জাতীয় পরিষদে যোগদান করতে পিন্ডি চলে গেছে। ১৭ই, ১৮ই, ১৯শে জুন ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবস উদ্যাপন করার আহ্বান জানাইয়াছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি ১৬ই আগস্টের পূর্বে সমস্ত গণবিরোধী ব্যবস্থার অবসান দাবি করিয়াছে। তা না করিলে ১৬ই আগস্ট থেকে জাতীয় পর্যায়ে গণআন্দোলন শুরু করা হবে। মনে মনে ভাবলাম আর কেউ আন্দোলন নষ্ট করতে পারবে না। দাবি আদায় হবেই।
৬ দফার বাস্তবায়নের সংগ্রাম আওয়ামী লীগ অব্যাহত রাখবে তাও ঘোষণা করেছে। এখন আর আমার জেল খাটতে আপত্তি নাই, কারণ আন্দোলন চলবে।
ভাবতে লাগলাম কর্মীদের টাকার অভাব হবে। পার্টি ফান্ডে টাকা নাই। আমিও বন্দোবস্ত করে দিয়ে আসতে পারি নাই। মাসে যে টাকা আদায় হয় তাতে অফিসের খরচটি চলে যেতে পারে। তবে আমার বিশ্বাস আছে, অর্থের জন্য কাজ বন্ধ হয়ে থাকে না। জনসমর্থন যখন আওয়ামী লীগের আছে, জনগণের প্রাণও আছে। আমি দেখেছি এক টাকা থেকে হাজার টাকা অফিসে এসে দিয়ে গিয়াছে, যাদের কোনো দিন আমি দেখি নাই। বোধ হয় অনেককে দেখবোও না। ভরসা আমার আছে, জনগণের সমর্থন এবং ভালবাসা দুইই আছে আমাদের জন্য। তাই আন্দোলন ও পার্টির কাজ চলবে।
সন্ধ্যার একটু পূর্বে বরিশাল থেকে বাবু চিত্ত সুতারকে নিয়ে এসেছে। আমার সামনেই বিশ সেলের ৫নং ব্লকে রেখেছে। এখানে পাবনার রণেশ মৈত্রও থাকেন। পরীক্ষা দিতে এসেছেন। দুইজন এক সাথেই থাকবে। ইনি এমপি ছিলেন, খুব নিঃস্বার্থ কর্মী। তাঁকেও ডিভিশন দেওয়া হয় নাই। তার কাছ থেকে খবর পেলাম আমার ভগ্নিপতির সাথে জাহাজে দেখা হয়েছে, আমার মা অনেকটা ভাল। মনে একটু শান্তি পেলাম।
চিত্তবাবু বললেন, অন্যান্য দল ভুল করেছে আওয়ামী লীগের ডাকে সাড়া না দিয়ে। আর আলাপ হতে পারল না। কারণ আমি রাস্তায় ছিলাম তাই একটু কথা হলো। তারপর তারা যার যার ব্লকে চলে গেল। আমি আমার ব্লকে একা, একেবারে একা। কথা বলারও লোক নাই, কয়েকজন সাধারণ কয়েদি ছাড়া। ডাক পড়েছে, বুড়া জমাদার সাহেব বন্ধ করতে এসেছেন। হ্যারিকেন জ্বালিয়ে কাগজ কলম নিয়ে আমার লেখার কাজে বসে পড়লাম।
১৩ই জুন ১৯৬৬ ॥ সোমবার
আজকাল খুব ভোরেই ঘুম থেকে উঠি। স্বাস্থ্য রক্ষা করারও চেষ্টা করি। বাইরে বসার জায়গায় যখনই বসেছি দেখি ইউনুস এসে হাজির। ঝাড় দেওয়ার কাজ করে। ইউনুসের বিশ বছরের সাজা হয়েছে। খুনের মামলা। সে বলে কিছুই জানি না। এর বেশি কিছু গোছাইয়া বলতে পারে না। আমাকে এসে ধরেছে, একটা কলম মাইরা দেন না, আমি খালাস হয়ে যাই। আপনি সইটা দিলেই হয়। রোজই দুই একবার একই কথা বলে থাকে। আজ আর ছাড়ছেই না। জমাদার, সিপাহি যেই আসে তারা ওকে বলে, সাহেবকে ভাল করে ধর, তা হলেই খালাস। জমাদার সিপাহিদের সে অনুরোধ করে গেটটা খুলে দিতে। তাহারা এখন মজা করে আমাকে দেখাইয়া দেয়। এক জমাদার সাহেব খুব রসিক মানুষ। বলে, ‘খালিখালি কি কাজ হয় পাকিস্তানে? কিছু খরচ টরচ করো। ইউনুসের কয়েক টাকা জমা আছে। মেট, পাহারা সকলকে বলে কিছু বাজার আনাইয়া দিতে। দুই টাকার বাজার, সিগারেট যে এনে দিবে তাকে আধা দিবে। বাকিটা আমাকে ও জমাদার সাহেবকে খাওয়াবে। সকলেই ওকে নিয়ে খেলা করে। আজ সত্য সত্যই সে বাজার আনতে গেটে রওয়ানা হয়েছে। অফিসে জমা টাকা থেকে সিগারেট, বিড়ি কিনে দেয়। এখন আর বিড়ি না, সকলে সিগারেট বা তামাক খায়।
আমি বললাম, ইউনুস কোথায় যাও?’ বলে বাজার আনতে যাই, স্যার। আমি রাগ করে বললাম, যদি বাজার আনো তবে আর আমি কলম মারব না। সে চুপ করে দাঁড়াইয়া রইল। না বাজার সে আনবে না, যদিও সিপাহি ও কয়েদিরা বলছে। কি করে ওকে বোঝাই আমার কলম যে ভোলা হয়ে গেছে। এ কলমে যে আজ আর কাজ হয় না। আমিও যে একজন ওরই মতো বন্দি সেটা আমি শত চেষ্টা করেও বোঝাতে পারি না। সকলেই ওকে নিয়ে তামাশা করে। ও যে একেবারে পাগল হয়ে যেতে পারে তাহা আমি সকলকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম। এখন এমন অবস্থা হয়েছে, কেউ কিছু না বললেও, সে আমার কাছে চলে আসে, আর ঐ একই কথা।
খবরের কাগজ এসেছে, আমিও এরমধ্যে খেয়ে নিয়েছি। সিলেটের বন্যায় দেড়লক্ষ লোক গৃহহীন। ১০ জন মারা গেছে। কত যে গবাদি পশু ভাসাইয়া নিয়া গেছে তার কি কোনো সীমা আছে! কি করে এদেশের লোক বাঁচবে তা ভাবতেও পারি না। তার উপর আবার করের বোঝা।
ডক্টর নূরুল হুদা সাহেব পূর্ব পাকিস্তানের বাজেট পেশ করেছেন। এক কোটি ১৬ লক্ষ টাকা নূতন কর ধার্য করেছেন। রাজস্ব খাতে আয় দেখাইয়াছেন ১১৮ কোটি ২৭ লক্ষ আর ব্যয় দেখাইয়াছেন ৯৮ কোটি ২৮ লক্ষ টাকা। উদ্বৃত্ত ১৯ কোটি ৯৯ লক্ষ টাকা। উন্নয়ন খাতে ব্যয় বরাদ্দ করেছেন ২৩০ কোটি, প্রাপ্ত সম্পদ ২০৪ কোটি ৬৯ লক্ষ টাকা। মোট ঘাটতি ২৫ কোটি ৩১ লক্ষ টাকা।
কত কর মানুষ দিবে! কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী শোয়েব সাহেব বলেছেন, জনসাধারণ অধিকতর সচ্ছল হইয়াছে তাই কর ধার্য করেছেন। তিনি যাদের মুখপাত্র এবং যাদের স্বার্থে কাজ করেছেন তারা সচ্ছল হয়েছেন। তাদের করের বোঝা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। শিল্পপতি ও বড় ব্যবসায়ীরা আনন্দিতই শুধু হন নাই, প্রকাশ্যে মন্ত্রীকে মোবারকবাদ দিয়ে চলেছেন। আর জনসাধারণ এই গণবিরোধী বাজেট যে গরিব মারার বাজেট বলে চিৎকার করতে শুরু করেছে।