ভারতবর্ষ যখন ভাগ হয় এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র যখন কায়েম হয় তখন রেলওয়ের ক্ষতিপূরণ পাওয়া গিয়েছিল সংখ্যানুপাতে। পূর্ব বাংলা টাকা বেশি পেয়েছিল ভাগে। দুঃখের বিষয়, যতদূর পশ্চিম পাকিস্তান রেলওয়ের উন্নতি হওয়া প্রয়োজন ছিল তাহা করে নিয়ে পূর্ব বাংলার রেলওয়ে আলাদা করে প্রদেশের হাতে দেওয়া হলো। সেই পরিমাণ ক্ষতিপূরণ কি দেওয়া হয়েছে? ভাল ভাল ইঞ্জিন ও বগিগুলি পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে নেওয়া হয়। কতগুলি নিয়েছে তার হিসাব কি তারা দিয়েছে? আজ পর্যন্ত চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত একটি ডাবল লাইন করা হয় নাই।
পশ্চিম পাকিস্তানে যেয়ে দেখুন কত বাহার। বিরোধী দল ও স্বতন্ত্রদল পূর্ব বাংলার আইন পরিষদের কক্ষ ত্যাগ করেছেন রেল দুর্ঘটনার মুলতবি প্রস্তাব অবৈধ ঘোষণার প্রতিবাদে। মুলতবি প্রস্তাব করে কেন এরা! বলবে, ডিবেট করবে, চলে আসবে। মাহিনা ও পাসগুলি থাকলেই তো চলে! চমৎকার আইন সভা! দুনিয়ায় এর নজির নাই।
এ তো মৌলিক গণতন্ত্র, এর সৃষ্টিকর্তা জনাব আইয়ুব খান। নিজকে পাকাপাকিভাবে ক্ষমতায় রাখার ব্যবস্থা। জনগণের কি প্রয়োজন এতে? মৌলিক গণতন্ত্রী আছে, টাকা আছে, সরকারি কর্মচারী আছে। আইয়ুব সাহেব আছেন ক্ষমতার শীর্ষে আর তার দুই ছোট লাট মোনায়েম খান সাহেব আর পশ্চিম পাকিস্তানে কালাবাগের খান সাহেব তো আছেন। চিন্তা কি?
সিলেটে ভয়াবহ বন্যায় বহু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আবার অনেক জায়গায় ঝড়েও যথেষ্ট মানুষ মারা গেছে ও ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে। জানি না সরকারি সাহায্য কত পরিমাণ পৌঁছাবে। সরকারি সাহায্যের নমুনা আমার জানা আছে, কারণ কক্সবাজারে ধ্বংসলীলা আমি দেখে এসেছি।
বিকালে হাসপাতালের দিকে চেয়ে দেখতে পাই শাহাবুদ্দিন চৌধুরী আমার দিকে চেয়ে আছেন। তাঁকে সালাম দিলাম এবং তাড়াতাড়ি সুস্থ হউন এই কামনা করলাম। বহুদূর, কথা বললে শুনবে না, আর বলাও উচিত নয়, আইনে বাধা আছে। দেখি বাদশা মিয়া (বাবু বাজারের) আমাকে সালাম দিচ্ছে। বেচারা জেল খাটতে খাটতে শেষ হয়ে গেল। তার শক্তি ও টাকাই তার কাল। বাদশা মিয়ার পিছনে দাঁড়াইয়া অনেকে আমাকে পিঠ দেখাল কেমন করে পুলিশ অত্যাচার করেছে। অনেকের মাথায় ব্যান্ডেজ, আহত হয়ে হাসপাতালে আছে। শুনলাম প্রায় ৪০/৫০ জন হাসপাতালে আছে। ক্ষোভে দুঃখে মনে মনে বললাম, মার খাও। তোমাদের জাত ভাইয়ের লাঠির বাড়ি ও বন্দুকের গুলি খাও। জেল জুলুম তোমাদের কপালে আছে। কারণ তোমরা তো পরাধীন বাঙালি জাতি। পরাধীন জাতের কপালে এমন লাঞ্ছনা ও বঞ্চনা হয়েই থাকে। এতে আর নতুনত্ব কি?
লেখাপড়া করতে ইচ্ছা হয় না। সময়ও কাটে না, জেলে রাতটাই বেশি কষ্টের। আবার যারা আমার মতো একাকী নির্জন স্থানে থাকতে বাধ্য হয়-যাকে ইংরেজিতে বলে ‘Solitary Confinement’—তাদের অবস্থা কল্পনা করা যায় না।
১২ই জুন ১৯৬৬ ॥ রবিবার
সকালে যখন হাঁটাহাঁটি করতেছিলাম তখন শুনলাম ৮২জন ছেলে জুন গ্রেপ্তার করেছে তাদের দুইটি ব্লকে রাখা হয়েছে। সর্বমোট ৮টা ছোট ছোট সেল, চার হাত চওড়া আট হাত লম্বা। দুই নম্বর ব্লক খালি করে খুব ভোরে একজনকে এনে রাখা হয়েছে। নাম আবদুল মান্নান। ভাবতে লাগলাম কোন মান্নান? জিজ্ঞাসা করলাম, চটকল শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কি না, কেউ বলতে পারল না। কোন ধারায় গ্রেপ্তার করেছে, বলল ডিপিআর না। খোঁজ নিয়ে জানলাম মামলা দিয়েছে নারায়ণগঞ্জ, তাতেই তাকে গ্রেপ্তার করেছে। ডিভিশন দেয় নাই। এক কাপড়ে এসেছে। জুতা খুলে রেখেছে গেটে। গামছা নাই, কাপড় নাই, কোনো জামা নাই, যে জামাটি গায়ে দিয়ে এসেছে তা ছাড়া। আমি তাড়াতাড়ি কিছু কাপড়চোপড় পাঠাইয়া দিলাম যাতে আপাতত চলতে পারে। ভাত নিতে যখন সেল থেকে বের হলো আমি দাঁড়িয়েছিলাম ওকে দেখতে। দেখলাম সত্যিই শ্রমিক নেতা মান্নান। তাকে বললাম, ‘চিন্তা করিও না, জামিনের চেষ্টা করতে হবে।’
কিছুই তো আমার ভাল লাগছে না। মায়ের খবর না পাওয়া পর্যন্ত মনকে সান্ত্বনা দিতে পারছি না। বাগানের কাজে হাত দিলাম। আবার ঘরে ফিরে এলাম। গতকালের কাগজগুলি আবার ভাল করে দেখতে লাগলাম। অর্থমন্ত্রী শোয়েব সাহেব ১৯৬৬-৬৭ সালের বাজেট পেশ করেছেন। রাজস্ব খাতে আয় ধরা হইয়াছে ৫৬৩ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকা। ব্যয় হইবে ৩৭২ কোটি ১০ লক্ষ টাকা। ১২৭ কোটি ৭৮ লক্ষ টাকা প্রদেশের ভাগে যাবে। রাজস্ব খাতে ৬৩ কোটি ৬৮ লক্ষ টাকা উদ্বৃত্ত থাকবে। উন্নয়ন খাতে আর্থিক বৎসরে ৪৪২ কোটি ৭৩ লক্ষ টাকা আয় হইয়াছে, ব্যয় বরাদ্দ হইয়াছে ৪৭৯ কোটি ২৯ লক্ষ টাকা। উন্নয়ন খাতে ৩৬ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকা ঘাটতি পড়িবে। নূতন কর বসাইয়াছে তাহাতে ৩৭ কোটি ১৫ লক্ষ টাকা আদায় হইবে। কেরোসিন, লবণ, সাবান অন্যান্য জিনিসের উপর কর ধার্য হয়েছে। ডাক মাশুলও বাড়াইয়াছে। দেশরক্ষা খাতে ২২৫ কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দ ধরা হইয়াছে। ১৯৬৫-৬৬ সালে ১৩৬ কোটি টাকা ছিল। যে কর ধার্য করা হইয়াছে তাহার সবটাই গরিবকে দিতে হইবে। শোয়েব সাহেব যে অর্থনীতি চাল করিয়াছেন তাহাতে গরিবকে আরও গরিব করিয়া কয়েকজন বড় লোক ও শিল্পপতিকে সুযোগ-সুবিধা করিয়া দিবার ষড়যন্ত্রই কায়েম হইবে।
সরকার ক্রমাগত কর ধার্য করিয়া জনসাধারণের দুঃখ দুর্দশা বাড়াইয়া চলিয়াছেন। শোয়েব সাহেব অর্থনীতিতে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা করিয়া চলিয়াছেন। তার বাজেটে এই শিল্পপতিদের ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ট্যাক্স হলিডে’ ভোগের ব্যবস্থা রাখিয়াছেন। কিন্তু গরিব জনসাধারণ বোধ হয় আর আলো জ্বালাইয়া রাতের খাবার খেতে পারবে না। খাবার জন্য কিছুই থাকবেও না। দেশ রক্ষা খাতে যে শতকরা ৬৫ ভাগ ব্যয় করা হবে এর মধ্যে পূর্ব বাংলা কতটুকু পাবে? ৫/১০ ভাগ এর বেশি নিশ্চয়ই না।