ফিরে এলাম আবার সেই নির্জন কারাগারে। আসার পথে কয়েদিরা আমাকে আদাব করল। কিন্তু ওদের দিকে চাইতে পারলাম না। শুধু হাত তুলে সালাম দিলাম ও লইলাম। আমার মনের অবস্থা দেখে মেট আলিমুদ্দি, বাবুর্চি, ফালতু ছুটে এল।
বললাম, “আমার মায়ের অসুখ।”
মনে পড়লো মা’র কথা। কিছুদিন আগে আমার মা খুলনা থেকে আমাকে ফোন করে বলেছিল, “তুই আমাকে দেখতে আয়, আমি আর বেশিদিন বাঁচব না। আমি বাড়ি যাইতেছি।” বললাম, “মা, আমি শীঘ্রই বাড়ি যাব তোমাকে দেখতে।” এরপর শুরু হলো আমার উপর জুলুম, যশোরে গ্রেপ্তার। আমি যখন খুলনা গেলাম, মা তখন বাড়ি চলে গিয়েছেন। যশোর থেকে ঢাকা এলাম। ঢাকায় গ্রেপ্তার করে নিয়ে চলল শ্রীহট্ট। সেখানে জামিন হলো। আবার জেলগেটে গ্রেপ্তার করে নিয়ে চলল ময়মনসিংহ।
জামিন পেয়ে ঢাকায় এলাম। সিলেটে তারিখের দিন হাজির হতে হবে। আটটা মামলা আমার বিরুদ্ধে। মাসের অর্ধেক দিন চলে যায়। বরিশালে প্রোগ্রাম দিলাম। ১২ই মে সভা করব। সেখান থেকে আমার বাড়ি কাছে। আব্বাকে খবর দিলাম ১৩ তারিখে বাড়িতে পৌঁছাব। আব্বা মা নিশ্চয়ই খুব খুশি হয়েছিলেন। আমার উপর আমার মা বাবার টান যে কত বেশি সে কথা কাহাকেও বোঝাতে পারব না। তারা আমাকে ‘খোকা বলে ডাকেন। মনে হয় আজও আমি তাদের ছোট্ট খোকাটি। পারলে আমাকে কোলে করেই শুয়ে থাকে। এই বয়সেও আমি আমার মা-বাবার গলা ধরে আদর করি। কিন্তু হঠাৎ ৮ই মে দিন গত রাতে ঢাকায় আমাকে বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা জেলে আটক করল। আমার সেই কথাই বার বার মনে পড়তে লাগল। “আমি বাঁচব না, আমাকে দেখতে আয়”-মা বলেছিলেন। কারও সাথে কথা বলতে ইচ্ছা হলো না। সন্ধ্যা হয়ে গেল। বিছানায় শুয়ে রইলাম। লেখাপড়া করতে পারলাম না। মেট আর বাবুর্চি জোর করেই আমাকে খাওয়াতে চেষ্টা করল। গতকাল খবর এল কত লোক মারা গেছে তেজগাঁও এবং নারায়ণগঞ্জে। আজ আবার মায়ের এই অবস্থা। তারপর আমাকে একাকী রাখা হয়েছে। অনেক চেষ্টা করলাম ঘুমাতে, পারলাম না।
১০ই জুন ১৯৬৬ ॥ শুক্রবার
আগেই লিখেছি আমাকে একা রাখা হয়েছে। কারও সাথে আলাপ করার উপায় নাই। কারও সাথে পরামর্শ করারও উপায় নাই। সান্ত্বনা দেবারও কেহ নাই। কারাগারের ভিতর একাকী রাখার মতো নিষ্ঠুরতা আর কি হতে পারে? অন্যান্য রাজবন্দিরা বিভিন্ন জায়গায় এক সাথে যাবে, কিন্তু আমাকে কারও কাছে দেওয়া চলবে না। সরকারের হুকুম। জেল কর্তৃপক্ষের কিছুই করার নাই। নূরুল ইসলাম চৌধুরী, খোন্দকার মোশতাক আহমদ, জহুর আহমদ চৌধুরী, মুজিবুর রহমান (রাজশাহী) এবং তাজউদ্দীনকে পূর্বেই ঢাকা জেল থেকে বিভিন্ন জেলে আলাদা আলাদা করে রেখেছে। আমাদের দলের আর যাদের গ্রেপ্তার করে এনেছে তাদের সবচেয়ে খারাপ সেলে রাখা হয়েছে। এদের খাবার কষ্টও দিচ্ছে। মাত্র দেড় টাকার মধ্যে খেতে হবে।
বাইরে যে ছোট বসার জায়গাটি আছে তার উপর বসেই চুপ করে আছি। জমাদার সাহেব এসে বললেন, চিন্তা করে শরীর নষ্ট করবেন না। দুই একজন কয়েদিও পাশ দিয়ে ঘুরে গেল, সাহস করে কিছুই বলল না। এইভাবে অনেক সময় কেটে গেল। ৯টার সময় ডিপুটি জেলার সাহেবকে খবর দিলাম আমার সাথে দেখা করার জন্য। তিনি খবর পেয়েই চলে এলেন। তাকে বললাম একটা টেলিগ্রাম করতে চাই চীফ সেক্রেটারির কাছে, এই কথা বলে, মায়ের শরীর খুবই খারাপ আমার গ্রামের বাড়িতে। যদি সম্ভবপর হয় আমাকে ছেড়ে দিতে পারেন। তিনি বললেন, দিয়ে দেন, আমরা তো পাঠাবার মালিক। টেলিগ্রাম লিখে পাঠাইয়া দিলাম। জানি কি হবে! এরা আমাকে ছাড়বে না। পরে বলবে, সরকারকে তো জানান হয় নাই। তাই জানাইয়া রাখলাম।
ইত্তেফাক কাগজেও মায়ের অসুখের কথা উঠেছে। অনেক চেষ্টা করি, চিন্তা করব না। তবুও বার বার একই কথা মনে পড়ে। আমার মার প্রত্যেকটি কথাই আমার মনে পড়তে থাকে।
পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পরেই ১৯৪৮-এ যখন আমাকে বাংলা ভাষা আন্দোলনের সময় গ্রেপ্তার করল, আবার ১৯৪৯ সালে গ্রেপ্তার করে ১৯৫২ সালে ছাড়ল, তখন আমার মা আমাকে জিজ্ঞাসা করল, বাবা, তুই তো পাকিস্তান পাকিস্তান করে চিৎকার করেছিস, কত টাকা নিয়ে খরচ করেছিস। এদেশের মানুষ তো তোর কাছ থেকেই পাকিস্তানের নাম শুনেছিল, আজ তোকেই সেই পাকিস্তানের জেলে কেন নেয়?
বলতে পারেন, আমার এই গ্রাম্য মার কথার কি জবাব দিব? বললাম মা তোমাকে পরে বলবো। কোনো কিছু বলার আমার ছিল কি? একদিন সুযোগ বুঝে মার কাছে অনেক কথা বললাম, মা কি বুঝতে চায়! আমার মাকে কোনোদিন বোঝাতে পারি নাই। মাঝে মাঝে আমাকে বলত, যে তোকে জেলে নেয় আমাকে একবার নিয়ে চল, বলে আসব তাকে মুখের উপর। আমার ভাইবোনেরা সকলেই হাসতে মার কথা শুনে। আজ মার অনেক কথাই আমার মনে জাগছে।
দৈনিক খবরের কাগজগুলি এল, দেখলাম কাগজগুলিকে সরকার সংবাদ সরবরাহ করা বন্ধ করে দিয়েছে। প্রায়ই প্যামফ্রেট করে রেখেছে। কোনো সংবাদই নাই এই আন্দোলনের।
জেলের কয়েদিদের খবর হলো, হাজার লোকের উপর মারা গেছে পুলিশের গুলিতে’—এমন অনেক খবর রটছে। সত্য খবর বন্ধ হলে অনেক আজগুবি খবর গ্রামে গ্রামে ছড়াইয়া পড়ে, এতে সরকারের অপকার ছাড়া উপকার হয় না।
আজ আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভা, যারা বাইরে আছেন যদি সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারেন তবে দাবি আদায় করতে বেশি সময় লাগবে না।