জমাদার ও সিপাহি সাহেবরাও তার গান শোনে। সকলেই ওকে স্নেহ করে, কারণ সরল লোক। মনে আর মুখে একই কথা। এ সমস্ত গান আমি যখন ছোট ছিলাম অনেক শুনেছি। জেলের মধ্যে এমন গান খুব ভালই লাগে। ওর তো কাজ আছে আমার তো কাজ নাই। ওকে ছেড়ে দিতে হলো। ঘরে এসে আবার সংশপ্তক বইয়ের মধ্যে নিজকে ডুবিয়ে দিতে চেষ্টা করলাম।
আজ খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টি থেমে গেলে গরমও পড়ে। পাখা খারাপ হয়ে গেছে খবর দিয়েছি মিস্ত্রী পাঠাতে। দিনভর বৃষ্টি। আজ আবার ন্যাপের জনসভা। সভাটি হওয়া প্রয়োজন। বহুদিন পরে এরা মিটিং করছে। মওলানা ভাসানী সাহেবের ভুল নীতির জন্য এই দলটি জনসমর্থন যা কিছু ছিল তাও হারাইয়া ফেলেছে দিন দিন।
আওয়ামী লীগ কর্মীদের গ্রেপ্তার করে চলেছে। আরও আটজন কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে বিভিন্ন জায়গায়। দমননীতি সমানে চালাইয়া যেতেছে সরকার। নির্যাতনের মধ্য দিয়ে গণদাবি দাবাইয়া দেওয়া যায় না। গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে, গণতান্ত্রিক পথেই মোকাবিলা করা উচিত। যে পথ অবলম্বন করেছে তাতে ফলাফল খুব শুভ হবে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগ কর্মীরা যথেষ্ট নির্যাতন ভোগ করেছে। ছয় দফা দাবি যখন তারা দেশের কাছে পেশ করেছে তখনই প্রস্তুত হয়ে গিয়াছে যে তাদের দুঃখ কষ্ট ভোগ করতে হবে। এটা ক্ষমতা দখলের সংগ্রাম নয়, জনগণকে শোষণের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য সংগ্রাম। যথেষ্ট নির্যাতনের পরেও আওয়ামী লীগ কর্মীরা দেশের আইন শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে নাই। তবুও পোস্টারগুলি পুলিশ দিয়ে তুলে ফেলান হতেছে। ছাপানো পোস্টার জোর করে নিয়ে যেতেছে সরকারি কর্মচারীদের দিয়ে।
আমার মনে হয় মোনায়েম খান সাহেব পশ্চিম পাকিস্তান গিয়ে কোনো কোনো বন্ধুর কাছ থেকে বুদ্ধি নিয়েছেন। তিনি ভুলে গেছেন এটা পূর্ব বাংলা, পশ্চিম পাকিস্তান নহে! আন্দোলন করা এবং নির্যাতন সহ্য করার ক্ষমতা এরা রাখে। তিনি অনেক বড় বড় কথা বলেন। রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে বকেই চলেছেন। মানুষের স্মৃতিশক্তি কিছুটা আছে, এত তাড়াতাড়ি তারা ভুলে যায় না। তিনি যখন খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব ও নূরুল আমীন সাহেবের সমর্থক ছিলেন তখন ময়মনসিংহ জেলা মুসলিম লীগের কর্মকর্তাও ছিলেন। মুসলিম লীগের নমিনী হিসেবে গণপরিষদের সদস্য হয়ে করাচীতে গিয়ে প্রত্যেক কাজে মুসলিম লীগকে ভোট দিয়েছেন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে দাবাইবার জন্য। ময়মনসিংহে গুণ্ডা ভাড়া করে আমাদের কর্মীদের উপর অত্যাচার করেছেন। পূর্ব-বাংলার যে-কোনো আন্দোলনের বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়াতেন, সেকথা ভোলেন কি করে? ময়মনসিংহের আওয়ামী লীগ সেক্রেটারি রফিকউদ্দিন ভূঁইয়াকে আড়াই বৎসর পর্যন্ত জেলে রাখার জন্য তিনিই দায়ী ছিলেন। নূরুল আমীন সাহেব তার কথা মতোই ময়মনসিংহে কাজ করতেন। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তিনি গণপরিষদের সদস্য ছিলেন।
১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলা থেকে বিতাড়িত হওয়ার পরেও ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি মুসলিম লীগে ছিলেন। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত এই দীর্ঘ ১১ বৎসরের মধ্যে ৯ বৎসর মুসলিম লীগ কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতায় ছিল। তখন তিনি মুসলিম লীগের সভ্য হয়েও একদিনও পূর্ব বাংলার শোষণের বিরুদ্ধে একটা কথাও বলেন নাই। শুধু সমর্থন করেন নাই, ভাতা নিয়ে সমর্থন করেছেন। তিনি যখন ইসলামের নাম করে সত্য কথা না বলে, এমন কি মাথায় কিস্তি টুপি দিয়ে রাজনীতিবিদদের গালাগালি করেন তখন হাসি পায়। বাইরে থাকতেও কোনোদিন এদের কথার উত্তর দিবার প্রবৃত্তি আমার হয় নাই। কারণ আমি জানি এদের চাকরি আইয়ুব খান সাহেবের দয়ার উপর নির্ভর করে। তাকে খুশি রাখলে সব ঠিক, জনমতের এরা কি ধার ধারে?
খবরের কাগজ এল। পাকিস্তান অবজারভার দেখে ভাবলাম বোধহয় খবর একটু এরা ছাপে আজকাল। আমি নিজে অবজারভার সকল সময়ই পড়ি। একবার কয়েকদিনের জন্য রাগ হয়ে বন্ধ করেছিলাম বাইরে থাকতে। আবার নিলাম, কারণ যাহাই হউক না কেন পূর্ব বাংলার কাগজ। মর্নিং নিউজের মতো পশ্চিমা শিল্পপতিদের মুখপাত্র নয়। এবং সরকারের অন্ধ সমর্থকও নয়। আজাদ কাগজ সকল সময়ই কিছু কিছু সংবাদ বহন করে। মতের মিল না থাকতে পারে, সংবাদপত্র কেন সংবাদ দিবে না। বিকাল পর্যন্ত কাগজই পড়লাম। এখন একমাত্র চিন্তা কর্মীরা নেতা ছাড়া আন্দোলন চালাইয়া যেতে সক্ষম হবে কিনা? আমার বিশ্বাস আছে আওয়ামী লীগের ও ছাত্রলীগের নিঃস্বার্থ কর্মীরা, তাদের সাথে আছে। কিছু সংখ্যক শ্রমিক নেতা-যারা সত্যই শ্রমিকদের জন্য আন্দোলন করে—তারাও নিশ্চয়ই সক্রিয় সমর্থন দেবে। এত গ্রেপ্তার করেও এদের দমাইয়া দিতে পারে নাই। ৭ই জুন হরতালের জন্য এরা পথসভা ও মিছিল বের করেই চলেছে। পোস্টার ছিড়ে দিলেও নতুন পোস্টার লাগাইতেছে, প্যামফ্রেট বাহির করছে। সত্যই এতটা আশা আমি করতে পারি নাই।
বিকাল বেলা বাইরে বসেই চা খেয়ে নিলাম। তারপর স্বাস্থ্যরক্ষার কাজে আত্মনিয়োগ করলাম। একটু পরেই আবার বৃষ্টি এল। সন্ধ্যার পূর্বে বৃষ্টি বন্ধ হলো। একটু বাইরে যেয়ে হাঁটাহাঁটি করছি এমন সময় দেখলাম, হাসপাতাল থেকে কে যেন আমাকে সালাম দিতেছে। অনেক দূরে চেনা যায় না। চোখে চশমা ছিল না। তবে ভাবলাম নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের কেহ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে এসেছে। চশমা আনতে বললাম। চশমা পরে দেখলাম, আরে এতো আমাদের শাহাবুদ্দিন চৌধুরী, ঢাকা শহর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। আমাকে ইশারা দিয়ে দেখাল, পেটে হাত দিল। বুঝলাম পেটের কোনো যন্ত্রণা এবং জ্বর হয়েছে। বেচারা আর কোনোদিন জেলে আসে নাই। এই প্রথম জেল তার মধ্যে আবার অসুখ হলে ভেঙে পড়বে। পরের দিন খবর নিলাম অনেকটা ভাল আছে।