মোস্তফা সরোয়ারের ব্যবসার খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে। পাটের ব্যবসা, একদিন না থাকলে সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। খুব আঘাত পেলাম। এই নেতৃবৃন্দ গ্রেপ্তার হওয়ার জন্য আন্দোলন যে পিছাইয়া যাবে না, সে সম্বন্ধে আমার সন্দেহ নাই। বুঝলাম সকলকেই আনবে জেলে। ধরতে পারলে কাউকে ছাড়বে না। মীজান ফিরে এসেছে এই একটা ভরসা। অনেকে আবার ভয়েতে ঘরে বসে যাবে, সে আমার জানা আছে। হাফেজ মুছা সাহেব বুড়া মানুষ, কষ্ট পাবেন হয়তো, পূর্বে কোনো দিন জেলে আসেন নাই। তবে শক্ত মানুষ। চৌধুরী সাহেব বেচারা খুবই নরম। আর সকলেই শক্ত আছে। আন্দোলনের ক্ষতি হবে এই ভাবনা আমার মনটাকে একটু চঞ্চল করেছে।
কোনোমতে খেয়ে বসে রইলাম, খবরের কাগজ কখন আসবে! কাগজ এল। বহুদিনের গোলমালের পরে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মধ্যে আপোষ হয়ে গেছে। বন্ধুভাবে বসবাস করার কথা যুক্তভাবে ঘোষণাও করেছে।
ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে খবর এসেছে পুলিশ বাহিনী নিজেরাই দিনের বেলায় ৭ই জুনের পোস্টার ছিড়ে ফেলছে। ঢাকা ও অন্যান্য জায়গায় তো করছেই। এই তো স্বাধীনতা আমরা ভোগ করছি!
এক অভিনব খবর কাগজে দেখলাম, মর্নিং নিউজ কাগজে ন্যাপ নেতা মিঃ মশিয়ুর রহমানের ফটো দিয়ে একটা সংবাদ পরিবেশন করেছে। ইত্তেফাক ও অন্যান্য কাগজেও খবরটি উঠেছে। তিনি ছয় দফার দাবি সম্বন্ধে তার মতামত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ছয় দফা কর্মসূচী কার্যকর হইলে, পরিশেষে উহা সমস্ত দেশে এক বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব জাগাইয়া তুলিবে। এমন কি তিনি যদি প্রেসিডেন্ট হতেন তাহা হলে ছয় দফা বাস্তবায়িত হতে দিতেন না। এদের এই ধরনের কাজেই তথাকথিত প্রগতিবাদীরা ধরা পড়ে গেছে জনগণের কাছে। জনগণ জানে এই দলটির কিছু সংখ্যক নেতা কিভাবে কৌশলে আইয়ুব সরকারের অপকর্মকে সমর্থন করছে। আবার নিজেদের বিরোধী দল হিসেবে দাবি করে এরা জনগণকে ধোঁকা দিতে চেষ্টা করছে। এরা নিজদেরকে চীনপন্থী বলে থাকেন। একজন এক দেশের নাগরিক কেমন করে অন্য দেশপন্থী, প্রগতিবাদী হয়? আবার জনগণের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে চিৎকার করে। ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করতে চাই না, তবে যদি তদন্ত করা যায় তবে দেখা যাবে, মাসের মধ্যে কতবার এরা পিন্ডি করাচী যাওয়া-আসা করে, আর পারমিটের ব্যবসা বেনামীভাবে করে থাকে। এদের জাতই হলো সুবিধাবাদী। এর পূর্বে মওলানা ভাসানী সাহেবও ছয় দফার বিরুদ্ধে বলেছেন, কারণ দুই পাকিস্তান নাকি আলাদা হয়ে যাবে।
মওলানা সাহেবকে আমি জানি, কারণ তিনিই আমার কাছে অনেকবার অনেক প্রস্তাব করেছেন। এমন কি ন্যাপ দলে যোগদান করেও। সেসব আমি বলতে চাই না। তবে সংবাদের সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী সাহেব জানেন। এসব কথা বলতে জহুর ভাই তাঁকে নিষেধও করেছিলেন। মওলানা সাহেব পশ্চিম পাকিস্তানে যেয়ে এক কথা বলেন, আর পূর্ব বাংলায় এসে অন্য কথা বলেন। যে লোকের যে মতবাদ সেই লোকের কাছে সেই ভাবেই কথা বলেন। আমার চেয়ে কেউ তাঁকে বেশি জানে না। তবে রাজনীতি করতে হলে নীতি থাকতে হয়। সত্য কথা বলার সাহস থাকতে হয়। বুকে আর মুখে আলাদা না হওয়াই উচিত।
বিকাল হয়ে গেল। কাগজ রেখে উঠে পড়লাম। একটু পরে দরজা বন্ধ করতে এল। ঘরে ঢুকে বই পড়তে শুরু করলাম। কাজ তো একটাই। খাওয়া শেষ করে এসে শুয়ে পড়া।
ভোর দুইটায় হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। এক পাগল ক্ষেপে গিয়েছে। খুব জোরে চিৎকার করছে আর গালাগালি করছে। সন্ধ্যার সময় এক পাগল চিত্তার করছিল, তাকে অন্য কোথাও সরিয়ে নিতে অনুরোধ করায় তাকে সরিয়ে নিয়ে গেছে। জেল কর্তৃপক্ষকে দোষ দিয়ে লাভ কি? কখন কোন পাগল ক্ষেপে উঠে বুঝবে কেমন করে? আর কি ঘুম হয়! বৃষ্টি হয়েছে, বেশ ঠাণ্ডাও পড়েছে।
৩রা জুন ১৯৬৬ শুক্রবার
ঘুমে যখন আর পড়তে পারি নাই তখন তালা খুলে দেওয়ার সাথে সাথেই বেরিয়ে পড়লাম। দেখি জমাদার সাহেব লুঙ্গি পরা দুইজন লোক নিয়ে পুরানা বিশ সেলের দিকে যাচ্ছেন। বৃষ্টি হচ্ছে, ছাতা মাথায়, বুঝলাম আরও কিছু আমদানি হয়েছে। জেলে নতুন কয়েদি এলে ‘আমদানি’ বলে, আর চলে গেলে খরচ’ বলে। আমার বারান্দা থেকে দেখা যায় পুরানা বিশ সেলে দুইজনকে রেখে জমাদার সাহেব ফিরে চলেছেন। বললাম, বোধ হয় রাতে ঘুমাতে পারেন নাই? সোজাভাবে জিজ্ঞাসা করলে বলবে না। বলল, আপনার জন্য কি আর শান্তিতে জেলের চাকরি করতে পারব! রাত দুইটা থেকে এই একই অবস্থা। একে আর কিছু জিজ্ঞাসা করলাম না। জেলের কয়েদিরা দুনিয়ার খবর রাখে। বৃষ্টি থেমে গেলে খবর পেলাম দুইজন এসেছে ১০ সেলে। এই দুইজনও শেখ সাহেবের দলের’-কয়েদিরা বলাবলি করতে থাকে। নাম কি করে জানবো? পরে খবর পাওয়া গেল, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুল হক সাহেব, আর একজন আওয়ামী লীগের সদস্য নন, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন জীবন ভরে, নাম আবদুল মাজেদ সরদার। পুরান ঢাকার নাম করা সরদার। বেলা ১২টার সময় তাকে আবার মুক্তি দেওয়া হলো ! কারণ বুঝতে কারও বাকি থাকে না!
আজ আর লেখাপড়ায় মন দিতে পারছি না। কি হবে বাইরে, কর্মীদের কি অবস্থা, অত্যাচার ও গ্রেপ্তার সমানে চলছে, আওয়ামী লীগ কর্মীদের উপর। দিন ভরই ছটফট করতে লাগলাম, কাগজ পাব কখন? একটা বেজে গেল, দুইটাও বেজে গেল, মনে মনে ভীষণ রাগ হলাম। জমাদার সাহেবকে খবর দিলাম। বললাম, কাগজ এখনও আসে নাই কেন? ভীষণ অন্যায় কথা। সকালে কাগজ আসে, আর এখন আড়াইটা প্রায় বাজে। তিনি জেল অফিসে চলে গেলেন। খবর নিয়ে এসে বললেন, ডিপুটি সাহেবের সই হয় নাই। দস্তখত না হওয়া পর্যন্ত কাগজ জেলের ভিতর আসে না, এখানেও সেন্সর হয়। তিনটার সময় কাগজ এল। অর্ধেক কাগজ কালো কালি দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। পড়ার উপায় নাই। যারা যারা গ্রেপ্তার হয়েছে তাদের নামও ঢেকে দিয়েছে। শুধু ইত্তেফাক নয়, আজাদ ও পাকিস্তান অবজারভার কাগজেও কালি দিয়ে দিয়েছে, অথচ জেল কর্তৃপক্ষের সেন্সর করার কোনো অধিকার নাই। জেলের মধ্যে কোনো ঘটনা, বা কোনো আসামি পালাইয়া গেলে, কেউ অনশন করলে কালি দিয়ে বন্ধ করে থাকেন, কিন্তু অন্য কিছু করা তাদের উচিত না। আমি জেলার সাহেব ও ডিপুটি সাহেবকে খবর দিলাম এর প্রতিবাদ করার জন্য। কাগজ দিতে যদি না চান, মানা করে দেন, কিন্তু কাগজ নষ্ট করবেন কেন!