কিন্তু তার স্বভাব মোটেই পরিবর্তন হয় নাই। খোকড় তার করতেই হবে। বি ক্লাস কয়েদি সকলেই তাকে সমীহ করে চলে। মার যে সে কত খেয়েছে তার সীমা নাই। একদিন বললো, কানে একটু কম শুনি, কারণ অনেক চড় কানে পড়েছে। শরীরের কোনো জায়গাই বাদ নাই মার খেতে।
আমার মনে হতো মার না খেলে লুদুর ভাল লাগে না। কাউকেও সে ভয় করে না, জেলে তাকে সকলেই সমীহ করে চলে। সুপারেনটেনডেন্ট যখন সাত দিনে একদিন ফাইল দেখতে আসে, লুদু সালাম করে দাঁড়াইয়া বলে, আমার নালিশ আছে হুজুর। পূর্বের সুপাররা নাকি বি ক্লাস কয়েদির কথা বেশি শুনতো না। নিয়ামতুল্লা সাহেব সকলের কথা মনযোগ দিয়ে শোনেন। আমি যখন জেলে, একদিন সুপার সাহেবকে আধাঘণ্টা দাঁড়া করে লুদু নালিশ করল। জেলার থেকে শুরু করে সুবেদার, ডাক্তার সকলের বিরুদ্ধেই সে বলল। কিছু কিছু সত্য কথাও বলেছিল। সে জানতো এই নালিশ করার পর তার বিপদ হবে। কিন্তু পরোয়া নাই। কারণ, তাকে রাতে সেলে থাকবার হুকুম দিয়েছে। দিনে সেল এরিয়ার বাইরে যাওয়ার হুকুম নাই। পানি টানে, ঝাড় দেয়, কাজ সে বেশি করে না। তার ইচ্ছা মতো চলে।
আমার বাগানে সে ঝাড় দিতে মাঝে মাঝে; গাছেও মাঝে মাঝে পানি দিত। আমি বললে আপত্তি করত না।
এবার লুদুর কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয়। সে বলে, ‘আর পকেট মারবো না, ভালভাবে থাকবো’। জেল হলে এখন তার আর ভাল লাগে না। তার স্ত্রীর কথা বলে মাঝে মাঝে দুঃখ করত। কারণ, শাশুড়ি নাকি তার স্ত্রীকে নিয়ে দুইবার তালাকের জন্য এসেছে। লুদু রাজি ছিল, তার স্ত্রী শোনে না, সে তার মাকে বলে দেখেই তো বিয়ে দিয়েছিলে যে ও চোর। তবে এখন কেন তালাক নিতে বল। আমার কপালে যা আছে তাই হবে। ও কতদূর যায় শেষ না দেখে ওকে ছাড়ব না। এই কথা লুদু বলে দুঃখ করে, আর বলে নিজের জন্য দুঃখ নাই, দুঃখ হলো ওর জীবনটা শেষ করে দিলাম। একটা ছেলে ছিল তাও মারা গেছে, ও কী করে থাকবে জানি না।
লুদু জেলের বাহির হয়ে কি করবে জানি না, তবে কথায় বার্তায় মনে হয়, ওর জীবনের উপর একটা ধিক্কার এসেছে।
২.১ ২রা জুন-১০ই জুন ১৯৬৬
সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুনলাম রাত্রে কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়ে এসেছে। কয়েদিরা আলোচনা করছে। ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। বুঝতে বাকি রইল না আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ এবং কর্মীদের নিয়ে এসেছে, ৭ই জুনের হরতালকে বানচাল করার জন্য। অসীম ক্ষমতার মালিক সরকার সবই পারেন। এত জনপ্রিয় সরকার তাহলে গ্রেপ্তার শুরু করেছেন কেন! পোস্টার লাগালে পোস্টার ছিড়ে ফেলা, মাইক্রোফোনের অনুমতি না দেওয়া, অনেক অত্যাচারই শুরু করেছে। জেলের এক কোণে একাকী থাকি, কিভাবে খবর জানব?
এদিকে কয়েদি ডিআইজি যথা জেল সুপারেনটেনডেন্ট সাহেব আজ সেল এরিয়ায় আসবে। সিপাই জমাদার সকলেই ব্যস্ত। আমাকে সেল এরিয়ায়ই রাখা হয়েছে। এখানে আমার ঘরটা ছাড়া সবই সেল। এখানে অনেক একরারী এবং সাংঘাতিক প্রকৃতির কয়েদি আছে। যারা একবার জেল থেকে পালিয়েছিল অথবা পালাবার চেষ্টা করেছিল, তাদের এই এরিয়ায় রাখা হয়। ডিআইজি সাহেব এক এক সপ্তাহে এক এক দিক পরিদর্শন করেন। কারও কোনো অসুবিধা হলে, কাকেও অন্যায়ভাবে অত্যাচার করলে, তার কাছে অভিযোগ করা যেতে পারে। কারও কোনো দুঃখ থাকলে তাও বলা যায়। যদি কোনো জেল কর্মচারী কোনো কয়েদির উপর অত্যাচার করে তাহলে তারাও নালিশ করতে পারে। তা ছাড়া পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আছে কিনা তাও দেখেন তিনি।
আজ সেল এরিয়ায় তিনি আসবেন। আমি জেলে আসার পর জেল আইজি সাহেব যখন এসেছিলেন তাঁর সাথে এসেছিলেন। আর একদিন রাত্রে যেদিন আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম, তিনি নিজেই সিভিল সার্জন সাহেবের সাথে দেখতে এসেছিলেন আমাকে, তখন রাত্র ১০টা।
আজ জেল সুপার পরিদর্শন করতে আসবেন, তাই হৈ চৈ পড়ে গেছে। চুনা লাগাতে লাগলো। পায়খানা পরিষ্কার করতে শুরু করল কয়েদিরা। সাজ সাজ রব। আমার মেট ও কয়েদিরা ঘরটাকে পরিষ্কার করল। রোজই কিছু কিছু করে। তবে আজ আলাদাভাবে। যদি কোনো আবর্জনা থাকে তবে মেট ও কয়েদিদের দণ্ড দেওয়া হয়। জেলের মধ্যে কয়েদির দণ্ড সবচেয়ে দুঃখের। এতে যে দিনগুলিতে কাজ করে মার্কা পায় সেগুলি কেটে দেওয়ার ক্ষমতা জেল কর্তৃপক্ষের আছে।
শুনলাম ১২/১৩ জন রাতে এসেছে। নাম কেউ বলতে পারে না বা বলতে পারলেও বলবে না। খবরের কাগজে কারও কারও নাম উঠবে। একই জেলে থেকেও কারও সাথে কারও দেখা হওয়া তো দূরের কথা, খবরও পাওয়ার সাধ্য নাই নতুন লোকের পক্ষে। তবে আমি পুরানা লোক—বহুবার এই জেলে অতিথি হয়েছি। এই জেলের সকলেই আমাকে জানে। নিশ্চয়ই বের করে নেব।
ডিআইজি সাহেব জেলের ডেপুটি জেলারসহ সকলকে নিয়ে আসলেন। আমার ঘরেও এলেন, একটু বসলেনও। জিজ্ঞাসা করলেন, এখন কেমন আছেন? বললাম শরীর অনেকটা ভাল, কোনো অসুবিধা নাই। কারণ, বলে কোনো লাভ নাই যে আমাকে কেন আলাদা করে একাকী রেখেছেন? গোয়েন্দা বিভাগ নাকি আদেশ করেছে। ভবিষ্যতে দরকার হলে কেউই স্বীকার করবে না, সে আমি জানি। যাহোক, তারপর তিনি উঠে গেলেন। আমি আমার জায়গায় বসে রইলাম। চিন্তা একই, কে কে এল!
আবদুল মোমিন এডভোকেট, প্রচার সম্পাদক আওয়ামী লীগ, ওবায়দুর রহমান, সাংস্কৃতিক সম্পাদক, হাফেজ মুছা, ঢাকা শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি, মোস্তফা সরোয়ার, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের সভাপতি, শাহাবুদ্দিন চৌধুরী, সহ-সভাপতি ঢাকা শহর আওয়ামী লীগ, রাশেদ মোশাররফ, সহ সম্পাদক, ঢাকা শহর আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগ কর্মী হারুনুর রশিদ ও জাকির হোসেন। দশ সেলে এদের রাখা হয়েছে। এত খারাপ সেল ঢাকা জেলে আর নাই। এখানে আমাদের প্রথম রাখা হয়েছিল। আমরা প্রতিবাদ করে ওখান থেকে চলে আসি। বাতাস ঐ সেলে ভুল করেও ঢােকে না। মন খুব খারাপ হয়ে গেল। ডেপুটি জেলার সাহেবকে বললাম। শুনলাম মোমিন সাহেব ডিআইজি সাহেবকে বলেছেন।