‘এইভাবে মাত্র পাঁচ মাস কাটালাম। হঠাৎ একদিন পকেট মারতে যাই রেলওয়ে স্টেশনে। রেলওয়ে যে জিআরপি পুলিশের আন্ডারে একথা আমি তখন জানতাম না। এদেরও যে হাত করতে হয় এ ধারণা আমার ছিল না। আমি পকেট মারতে যেয়ে ধরা পড়ে গেলাম টাকা সমেত। আমাকে জিআরপি অফিসে নিয়ে খুব বানানো হলো। তারপরে বলল, নতুন বুঝি পকেট মারিস, কোনো খবর টবর রাখিস না। একজন পুলিশ এসে আমাকে বলল, “তোর বাড়ি কোথায়? টাকা খরচ করতে পারবি?’ লুদু বলল, কিছু তো পারি। যদি ব্যয় করতে রাজি হইস, তবে তোকে ছাড়াইয়া দিতে পারি দারোগা সাহেবকে বলে। পুলিশটা ১০০ টাকা চাইলো দারোগা সাহেবের জন্য, আর নিজের জন্য পঁচিশ টাকা। লুদু তাকে বললো, “অত টাকা তো ঘরে নাই, তবে ৭০ টাকা দারোগা সাহেবকে দেন, আর আপনি ২০ টাকা নেন। রাজি হলো, আমি আমার ছোট ভাইয়ের ঠিকানা দিয়ে থানার ঐ সিপাহিকে পাঠালাম। সিপাহি আমার ভাইকে নিয়ে হাজির হলো। দারোগা সাহেবকে টাকা দিলে তিনি সিপাহিকে কি যেন বলে বিদায় দিলেন। একটু পরে আমাকে ছেড়ে দিলেন।
এইভাবে জিআরপি পুলিশকে হাত করলাম। রোজ পকেট মারতাম। সকালে স্টেশনে, জিআরপিকে ভাগ দিতাম। আর বিকালে পকেট মারতাম সদরঘাট, তার ভাগ দিতাম কোতওয়ালী থানায়। এইভাবে দুই বৎসর চলল।
এর মধ্যে একটা বাসে পকেট মারতে চেষ্টা করেছি, দেখি এক ভদ্রলোক আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি হাত টান দিয়ে নিয়ে এলাম। ভদ্রলোক আমাকে চোখ ইশারা দিল পকেট মারতে। প্রথম ধকল যখন কেটে গেল তখন আবার পকেট মারলাম। আমি যখন নামলাম ঐ ভদ্রলোকও দুইজন লোক নিয়ে নামল। আমি তাদের নিয়ে এক রেস্টুরেন্টে গেলাম। পকেট মেরে খামের মধ্যে ৭০০ টাকা রেখেছিলাম, আমি হাত সাফাই করে সরাইয়া ছিলাম ৪০০ টাকা, খামের মধ্যে থাকলো ৩০০ শ’ টাকা। লুদু বললো, এই দুই ভদ্রলোক তাকে বলেছিল, এরা সিআইডি। টাকা ভাগ হলো, লুদুর ১০০, আর ওদের ২০০। কথা ঠিক হলো এইভাবে বাসে গাড়িতে পকেট মারবে, আর এরা লুদুকে বাঁচাইয়া দিবে। লুদু যখন পকেট মারত এরা প্রায়ই তার সাথে থাকত। কয়েকবার ধরা পড়েছে, এরা বলে কয়ে ছাড়াইয়া দিয়াছে। মাইরের হাত থেকেও আমাকে অনেকবার রক্ষা করেছে। এভাবে সিআইডি অফিসও আমার হাতে হয়ে গেল। আমি বেপরোয়াভাবে পকেট মারা ও চুরি করা শুরু করলাম। লুদু বলল, এই সময় আমি লোহারপুলের কাছে সূত্রাপুর বাজারে পকেট মারতে চেষ্টা করায় হাতেনাতে গ্রেপ্তার হই। সূত্রাপুর থানায় আমি কিছু দেই নাই, দিলেও বোধহয় উপায় ছিল না। কারণ যাদের হাতে ধরা পড়েছি তারা বাইরের লোক। এই কেসে তিন মাস হাজতখানায় খাটার পর আমার দেড় বছরের জেল হয়।
আমি জেলে এসে এবার ভালই পাকা হলাম। গলার ভিতর ‘খোকড় বা ভাণ্ডার করা শিখলাম। পেশাদার ডাকাত, চোরদের গলায় একপ্রকার গর্ত করা থাকে; এরা গলার ভিতর ডাক্তার দিয়ে অপারেশন করে থােকড় করে। এই খোকড়ে ৫/৭টা মোহর অথবা ৮ থেকে ১০টা গিনি একসাথে রাখা যায়। কাঁচা টাকা প্রায় ৭-৮টা এক সাথে রাখা যায়। এমনকি ১০০ টাকার নোট সিগারেটের কাগজ দিয়ে মুড়ে দুই তিনখানা একসাথে রাখা যায়। না দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না। এরা টাকা রাখে কারণ, জেলে এসে সিপাহি জমাদারদের টাকা দিয়ে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়। এরা গাঁজা, আফিম, চরস সরাব সবকিছু কিনে এনে খায়। এই টাকা খরচ করে জেল কর্তৃপক্ষের কর্মচারীদেরও মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়।
চোর-ডাকাতকে যখন থানায় থানায় মারপিট করে তখন একখানা গিনি বের করে দিলে আর মার খেতে হয় না। জামিনও পাওয়া যায়। লুদু এই সময় ‘খোকড়’ তৈয়ার করার চেষ্টা করতে লাগল। ‘খোকড়’ দুই রকমের; কাঁচা ও পাকা। কাচা খোকড় বন্ধ হয়, বেশি কিছু রাখা যায় না। গলা টিপলে মাথায় মারলে হঠাৎ পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু পাকা খোকড় থেকে চেষ্টা করলেও টাকা বা গিনি বের করা যায় না—যে পর্যন্ত নিজে থেকে বের করে দেয়। লুদু কাঁচা খোকড় করার জন্য গলার ভিতর সীসা গোল করে সুতা বেঁধে গলার মধ্যে রেখে দিত। সুতা দাঁতের সাথে বাধা থাকে, যাতে ভেতরে না চলে যায়। এইভাবে অনেকদিন রাখলে একটা গর্ত হয়। এই গর্তের উপর সোনা রাখতে পারলে আস্তে আস্তে পাকা হয়ে যায়। তা না হলে বাইরে যেয়ে ডাক্তার দ্বারা অপারেশন করে পাকা করা হয়। লুদু কাঁচা খোকড় তৈয়ার করল। এই সময় জেলে ছোকরা নিয়ে ছোরা-মারামারি করায় দশজনকে বদলি করল। এই জেলেই লুদুকে বাকি দিনগুলি খাটতে হলো।
লুদু বলে, এই বার জেল থেকে একবারে পাকা চোর হয়ে ফিরে এলাম। পাকা ‘খোকড়’ করলাম, দলবল খোঁজ করে তিনজন একসাথে হলাম। ঠিক করলাম, ঢাকা শহরে পকেট কেটে বেশি দিন বাইরে থাকা যাবে না। বিদেশেই যেতে হবে। তিনজন এক সাথে হয়ে সিলেট জেলায় গেলাম। সিলেট তখন আসামের ভিতর। লুদু বলল, তারা চামড়ার ব্যাপারী সেজে শ্রীমঙ্গলে এক বাড়িতে আশ্রয় নিল। দুই একটা চামড়া কিনতো, লবণ লাগাতো আর পকেট মারতো। এখানে সেই বাড়িওয়ালার এক মেয়েকে সে বিবাহ করে। কয়েকদিন পরে আবার ধরা পড়ে মৌলভীবাজার জেলে যেতে হলো। মেয়েপক্ষ যখন খবর পেল লুদু একটা দাগী চোর, তখন জেলে গিয়ে তার কাছ থেকে মেয়েটার তালাক নেওয়াইল। এখানে লুদুর ৯ মাস জেল হলো। এরপর আরও কয়েকবার জেল হয়।
১৯৪৯ সালে যখন আমি জেলে তখন লুদুর সাথে আমার পরিচয় হয়। ১৯৫২ সালে লুদু মুক্তি পায়, আবার ১৯৫৩ সালে গ্রেপ্তার হয়। এইবার ওর নয় বৎসর জেল হয়, তিনটা মামলা মিলে। ভালভাবে জেলে থাকলে ৬ বৎসর খেটে বের হতে পারতো।