লুদুর বড় ছিল এক ভাই, সে রাজমিস্ত্রির কাজ নিয়েছিল। যা কিছু উপার্জন করত নিজেই ব্যয় করত, আর বাবার কিছু গুণও পেয়েছিল। ঘোড় দৌড়, জুয়াও শুরু করল।
লুদুর বাবা অন্য বিবাহ করার জন্য তার মাকে দেখতে পারতো না। তাই বাধ্য হয়ে লুদু মাকে নিয়ে আলাদাভাবে বাস করতে লাগল। সেই সময় লুদুকে দর্জির কাজ শিক্ষা করার জন্য ওর বড় ভাই এক দর্জির দোকানে দিল। প্রায় এক বছর থাকার পর ওর বাবা তাকে ফিরাইয়া আবার রাজমিস্ত্রির সাথে জোগালির কাজ করতে দিল। একাজে যা কিছু পেত তাতে সংসার চলত না।
এই সময় ওর বাবার মৃত্যু হলো, বড়ভাই সংসারের মালিক হলো। লুদু লেখাপড়া শিখতে চায়। তাই বড় ভাইকে বলল তাকে স্কুলে দিতে। কিন্তু বড় ভাইয়ের সংসারে টানাটানি, তার টাকার প্রয়োজন। ওদের ওপর অত্যাচার করতে লাগল। বাধ্য হয়ে একদিন লুদু ও তার ছোট ভাই বাড়ি ত্যাগ করে নানার বাড়ি চলে গেল। নানাবাড়িও ঢাকা শহরে। নানার বাড়িতে খায় আর ঘুরে বেড়ায়। এই সময় সে দেখতে একদল যুবক চাখানায় চা খায়, আড্ডা মারে, জুয়া খেলে, দুই হাতে টাকা উড়ায়।
ওর নানার বাড়ির পাশেরই একটা যুবক চুরি করত। তার নাম গোপাল। গোপালের সাথে লুদুর পরিচয় হয়। তার সাথে মাঝে মাঝে বেড়াতে যেতো। সে লুদুকে বলল, কি করিস, তুই আমার সাথে কাজ করলে তোর বেশ কিছু টাকা পয়সা হবে। লুদুকে সকল কথা গোপাল খুলে বলল। একদিন ঠিক হলো গোপাল ওকে নিয়ে রাতে চুরি করতে যাবে। ভয় পেলে চলবে না। যা বলবে তাই করতে হবে। এইভাবে মাঝে মাঝে গোপালের সাথে চুরি করত। গোপাল ওকে কিছু কিছু টাকা দিতো। তার হাতে টাকা আসাতে তার খুব ফুর্তি হলো। বেশ ব্যয় ট্যয় করত চা সিগারেট খাইতে, দু’একখানা ভাল কাপড়ও পরতো। কিছুদিন গোপালের সঙ্গে চুরি করার পরে বোধহয় ১৩/১৪ বৎসর বয়সে নিজেই একদিন চুরি করতে লোভ হলো। একলাই চুরি করবো, তবে সকল টাকা একারই হবে। প্রথমে চুরি বেশ সুন্দরভাবে করে আসতে লাগল। সাহস বেড়ে গেল। এইভাবে তিন মাস পর্যন্ত মাঝে মাঝে সুযোগ পেলে একলাই চুরি করত। কিছু টাকা যখন লুদুর হাতে এল তখন সে তার ছোট ভাইকে স্কুলে দিল।
এই সময় একবার একা চুরি করতে যেয়ে ধরা পড়ল। বেশ কিছু উত্তম মধ্যম দিয়ে থানায় দেওয়া হলো। দারোগা সাহেব হাজতে পাঠাইয়া দিয়া একটা মামলা দায়ের করলেন। প্রায় তিন মাস হাজত খাটতে হলো। এই সময় লুদুর সাথে অনেক পুরানো চোরের পরিচয় হয় এবং তাদের কাছ থেকে চুরির নতুন নতুন ফন্দিও কিছু শেখে। ম্যাজিস্ট্রেট লুদুর অল্প বয়স বিবেচনা করে তাকে মুক্তি দিতে রাজি হলেন। শর্ত হলো, যদি লুদুর বড় ভাই একশ’ টাকার জামিন হয়, এক বছরের মধ্যে যদি আর কোনো চুরি বা খারাপ কাজ না করে তবে তাকে ক্ষমা করা হবে। সুদুর বড় ভাই তার মায়ের কান্নাকাটিতে রাজি হয়ে একটা বন্ড লিখে দিয়ে ওকে খালাস করে নিয়ে যায়।
কয়েক মাস ভাল থাকার পরে আবার চুরি করতে আরম্ভ করে। কারণ, টাকার তার প্রয়োজন। দুই তিন মাস পর আবার চুরি করতে যায়। জেলের এক চোরের সাথে তার আলাপ হয়েছিল, সে খালাস পেয়ে লুদুকে নিয়ে চুরি করতে যেয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে যায়। এইবার লুদুর নয় মাস কারাদণ্ড হয়। জেলখানায় ছোট ছোট ছেলেদের কয়েদিরা খুব ভালবাসে। অনেকে নিজের ছেলেমেয়েকে ফেলে আসে তাই পিতৃবাৎসল্য জেগে ওঠে। ছোট ছোট ছেলেদের দেখলে এরা না খাইয়া সেই বাচ্চাদের খাওয়ায়।
আর একদল-যারা ছোকরাবাজ তারাও এদের পিছনে লাগে। ভাল ভাল জিনিস জোগাড় করে খাওয়ায়। বিড়ি তামাকের অভাব হয় না। জঘন্য লোকগুলো এই ছেলেগুলিকে খারাপ করে ফেলে।
জেলে নয়মাস লুদুর কোনো কষ্ট না হওয়াতে তার মনে ধারণা হলো যে, জেল তো কিছুই না। এখানে আসলে আরামই পাওয়া যায়। সাথে সাথে পেশাদার চোরদের কাছ থেকে অনেক রকমের চুরির ফন্দি সে শিখে নেয় এবং দল সৃষ্টি করে। বাইরে এসে সকলে এক হয়ে চুরি করে। যখন নয় মাস পরে খালাস হলো, তাকে পুলিশের নজরে রাখার জন্য এক বৎসরের হুকুম হলো। প্রতি রাতে ১২টা থেকে ৪টা পর্যন্ত পুলিশ তাকে ডেকে দেখতো সে ঘরে আছে কিনা।
জেলখানায় আসার আগে কি করে পকেট মারতে হয়, তা সে শিখে এসেছিল। রাতে যখন পুলিশ তার ঘরে পাহারা দেয়, তখন দিনেই পকেট মারা ভাল মনে করলো সে। লুদু পকেট কাটতে শুরু করলো। প্রায় পাঁচ মাস এইভাবে চলল। এই সময় একদিন পুলিশ এসে তাকে থানায় ডেকে নিয়ে বলল, তুই কি করিস সে খবর রাখি; তোকে এবার ধরতে পারলে জেল দেওয়াব তিন বছরের জন্য আর বেতের বাড়ি তোর খেতে হবে। তুই কেন আমার সাথে দেখা সাক্ষাৎ করিস না। তখন লুদু ভাবল যে থানার সাথে বন্দোবস্ত করলে বিপদ হবে। যখন দারোগা সাহেব বললেন দেখা সাক্ষাৎ কেন করিস না, তখন বুঝতে পারলো যে কিছু দিতে হবে।
একদিন পকেট মেরে বেশ কিছু টাকা পেয়ে লুদু ভাবলো দেখা যাক দারোগা সাহেব কি করেন। বাজার থেকে বড় একটা মাছ, কিছু পটল, কিছু আলু, আর দশটা টাকা নিয়ে দারোগা সাহেবের বাসায় গিয়ে চাকরকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, সাহেব বাড়ি আছে কি না? সে উত্তর দিল ঘরে আছে। তাকে বল যে লুদু আসছে দেখা করতে। লুদু-সেই লুফর রহমান লেনের পকেটমার। দারোগা সাহেব বেরিয়ে এসে বললেন, কি জন্য আসছিস, এইগুলি আবার কি? লুদু দেখল, দারোগা সাহেব খুব খুশি হয়েছেন। লুদু বলল, হুজুর সামান্য জিনিস এনেছি, গরিব মানুষ কোথায় পাবো! দারোগা তার চাকরকে বললো এগুলো ভেতরে নিয়ে যাও। দশটা টাকাও লুদু দিল। টাকা পকেটে রেখে দারোগা বললেন, ‘বোধহয় ভাল দান মেরেছ, তা মাত্র দশ টাকা কেন? বেশি কিছু দেও। লুদু বলল, সামান্যই পেয়েছিলাম, আমার দিকে একটু লক্ষ্য রাখবেন। মাঝে মাঝে কিছু দেবার চেষ্টা করব। দারোগা সাহেব বললেন, সপ্তাহে কত দিবি বল?’ লুদু বলল, “তা কেমন করে বলব, কিছু মারতে পারলেই আপনার জন্য নিয়ে আসব। দারোগা সাহেব বললেন, “ঠিক আছে, তবে হাওয়ালদার, সিপাহিদের দেওয়ার জন্য সপ্তাহে ১০ টাকা দিবি। আর চুরি করলে, তার কিছু ভাগ আমাকে দিয়ে যাবি। কারণ খবর আমার কাছে আসবে। তোকে আর রাতে ডাকা হবে না, কাজ চালাইয়া যা। দারোগা হাওয়ালদারদেরকে বলে দিল আমাকে আর রাতে ডাকাডাকি না করতে। আমি রাতে চুরি করতাম, আর দিনে পকেট মারতাম। বেশ টাকা পয়সা আমার হাতে আসতে লাগল। জুয়া খেলা, তাড়ি খাওয়াও শুরু করলাম।