জেলে আসলে অন্য পকেটমারদের বা ডাকাতদের কাছে থেকে বেশ ট্রেনিং পায়, বাইরে যেয়ে আরও বড় ডাকাত হয়। জেল দিয়ে লোকের চরিত্র ভাল হয়েছে বলে আমি জানি না।
একবার জেলে আমি শুয়ে শুয়ে খবরের কাগজ পড়ছি। আমি একলা থাকতাম, অন্য রাজবন্দিদের আমার সাথে রাখা হতো না। একটা ঘরে যাকে দেওয়ানী বলা হয়-সেখানে আমি থাকতাম। আমার দেখাশুনা ও পাক করার জন্য দুইজন কয়েদি ছিল। একজনের নাম নবাব আলি, গ্রাম-শংকর, পোঃ-বোয়াইল, থানা-ধামরাই, জিলা-ঢাকা। আর একজনের নাম হোসেন খা, গ্রাম-সরাকাঠি, পোঃ-শ্যামপুর, জিলা-বরিশাল। প্রথমজনের ১০ বৎসরের আর দ্বিতীয়র ৭ বৎসরের জেল হয়েছে খুনের মামলায়। বাইরে কাজ করছে। সিপাহি বলে পাহারা দিচ্ছে বাইরে।
এটা ১৯৪৮ সালের ঘটনা, বোধ হয় ডিসেম্বর মাস। হঠাৎ একজন কয়েদি পাহারা আমার পা জড়াইয়া ধরে শুধু বলছে আমাকে বাঁচান। আমাকে মেরে ফেললো। আমার কাছে কোনো কয়েদির রাখার বা কথা বলার হুকুম নাই। আমি হঠাৎ চমকাইয়া উঠে জিজ্ঞাসা করলাম “কি ব্যাপার! তুমি এখানে কি করে এলে? কি হয়েছে বলো। সে কাঁপছে আর বলছে ‘একজনকে মেরেছি, এখন আমাকে ধরে নিয়ে মারবে। বিচারে যে শাস্তি হয় তাতে আমার আপত্তি নাই, তবে আমাকে না মারে। এর মধ্যে সিপাহি ছুটে এসে একে ধরে ফেলেছে। মেট, পাহারা, জমাদার সকলে ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কোথায় পালালো। পরে ওকে ধরে নিয়ে গেল কেস টেবিলে। সেখানে সুবেদার আছে, আমি বলে দিলাম জমাদারকে ওকে যেন না মারা হয়। কারণ ও যখন চলে এসেছে আমার কাছে আশ্রয় নিতে, ওকে মারবেন না। জমাদার, সিপাহি, মেট ‘পাহারা আমার কথা শুনলো। এর মধ্যে দেখি একজন কয়েদিকে ৫/৬ জন কয়েদি ধরে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। ভীষণভাবে জখম হয়েছে। কয়েদিটা ঘুমাইয়া ছিল। সে অন্য জায়গায় কাজ করত তাকে লোহার একটা লাঠি দিয়ে ঘুমন্ত অবস্থায়ই মুখে আঘাত করে, একটা দাঁত পড়ে যায়, আর কতগুলি নড়ে যায়। আর যে এসে আমার পা ধরেছে, যে মারলো তার নাম হলো আলি হোসেন। বিশ বৎসর সাজা, যাকে বলা হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এর বাড়ি ময়মনসিংহ জেলায় আর যাকে মেরেছে তার নাম হলো মাহতাব, বাড়ি ঢাকা।
এদের মধ্যে গোলমাল চলেছে বহুদিন থেকে, কারণ দুইজনই একজন ছোকরা কয়েদিকে পছন্দ করত। আলি হোসেন ছোকরাটাকে সকল সময় যত্ন করত, খাওয়াতো। বিড়ি দিত, কিন্তু ছোকরাটা মাহতাবের কাছেই থাকত। ওর কাছে বেশি যেতো, খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলেই চলে যেত মাহতাবের কাছে। রাতেও মাহতাব যেখানে পাহারা দিত সেখানেই ও থাকত। তাই রাগ হয়ে মাহতাব যখন ভাত খেয়ে ঘুমায়েছিল ওর নিজের জায়গায় তখন অন্য জায়গা থেকে আলি হোসেন সিপাহি জমাদারদের ফাকি দিয়ে সেখানে যেয়ে মেরে এক দৌড়ে পালাইয়া আমার কাছে চলে আসে। ধরা পড়লে বেশ ‘ধোলাই করা হতো। ধোলাই কথা ব্যবহার হয় জেলখানায়; বেশ মতো যাকে মারা হয় তাকে এককথায় ‘ধোলাই’ করা বলে। এই রকম অনেক ঘটনাই জেলে ঘটে থাকে।
ঢাকা জেলে প্রায় দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার কয়েদি ও হাজতি আছে।
১৯৫০ সালে যখন জেলে ছিলাম তখন একজন কয়েদির সাথে আলাপ হয়। নাম তার লুদু ওরফে লুঙ্কর রহমান। ঢাকা শহরের লুঙ্কর রহমান লেনে তার বাড়ি। আমি তাকে ১৯৫৪ সালে দেখে যাই, আবার যখন ১৯৫৮ সালে মার্শাল ল জারি হয় এবং আমাকে গ্রেপ্তার করে-জেলে এসে দেখি লুদু আছে। সে নিজকে সকলের চেয়ে সিনিয়র কয়েদি হিসেবে জাহির করত এবং দাবিও করত। জেলের সাধারণ আইন কানুন তার কণ্ঠস্থ ছিল। কথায় কথায় আইন ঝাড়তো। তার মতের বিরুদ্ধে কিছু হলেই সে সুপার ও জেলার সাহেবের কাছে নালিশ করত। সে বি-ক্লাস’ কয়েদি ছিল। সাধারণ কয়েদিরা তাকে ভয় করে চলত। কারণ সে খুব সাহসী, সহজে কাউকে মানতো না। আমি যেখানে থাকতাম সেখানে সে পানি দিত ও ঝাড় খাতায় কাজ করত। একজন জেল ওয়ার্ডার আমার ওখানে ডিউটি দিত। লোকটা অমায়িক ও ভদ্র, নাম তার কাদের মিয়া। সে লুদুকে বলতো, লুদু ভাল হও, আর চুরি করো না। আমি ঘরে বসে বই পড়তাম, তাদের কথা ভেসে ভেসে আমার কানে আসত। আমি তাদের আলাপ চুপচাপ করে শুনতাম।
লুদুকে আমি ডেকে বললাম, লুদু তোমার জীবনের ঘটনাগুলি আমাকে বলবা। লুদু বললো, “হুজুর আমার জীবনের কথা নাই বা শুনলেন, বড় দুঃখের জীবন। প্রায় ২০ বৎসর আমার জেলখানাতে হয়েছে। ১৩ বৎসর বয়স থেকে চুরি ও পকেট মারতে শুরু করেছি। কেন যে করেছিলাম আজও জানি না। তবে মাঝে মাঝে ভাবি কেন এই পথ নিয়েছিলাম। জীবনটা দুঃখেই গেল। বোধ হয় জীবনে আর শান্তি হবে না। চোর ও পকেটমারের জীবনে শান্তি হয় না। লুদু বলতে বলতে চোখের পানি ফেলেছিল, বোধহয় অনেক দুঃখের কথা তার মনে ভেসে এসেছিল।
লুদু বলতে লাগল, আর আমি ঘটনাগুলি লিখতে শুরু করলাম। একটা সামান্য চোরের জীবন আমি কেন লিখছি—এ প্রশ্ন অনেকেই আমাকে করতে পারেন। আমি লিখছি এর জীবনের ঘটনা থেকে পাওয়া যাবে আমাদের সমাজ ব্যবস্থার চিত্র। মনুষ্য চরিত্র সম্বন্ধে, যারা গভীরভাবে দেখতে চেষ্টা করবেন, তারা বুঝতে পারবেন আমাদের সমাজের দুরবস্থা এবং অব্যবস্থায় পড়েই মানুষ চোর ডাকাত পকেটমার হয়। আল্লাহ কোনো মানুষকে চোর ডাকাত করে সৃষ্টি করে না। জন্ম গ্রহণের সময় সকল মানুষের দেল একভাবেই গড়া থাকে। বড় লোকের ছেলে ও গরিবের ছেলের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না, যেদিন জন্মগ্রহণ করে। আস্তে আস্তে এক একটা ব্যবস্থায় এক একজনের জীবন গড়ে ওঠে। বড়লোক বা অর্থশালীর ছেলেরা ভাল খায়, ভাল পরে, ভাল শিক্ষা পায়। আর গরিবের ছেলেরা জন্মের পরে যে অবস্থা বা পরিবেশে বেড়ে উঠে এবং যাদের সাথে মেলামেশা করে তাদের স্বভাব চরিত্রই তারা পায়। লুদুর বাবার অবস্থা নেহাত খারাপ ছিল না। খেয়ে পরে সুখেই ছিল। কিন্তু সাতটা বিবাহ করে এবং বহু ছেলেমেয়ে জন্ম দেয়। সাথে সাথে কিছু বদ অভ্যাসও ছিল-মদ, তাড়ি খেয়ে টাকা উড়াইতো। তারপরে যাহা বাচতো রবিবার পকেটে করে ঘোড় দৌড় খেলায় তাহাও শেষ করে ফতুর হয়ে আসত। এইভাবে আস্তে আস্তে সংসার ভেঙে পড়তে লাগল। অভাব অভিযোগ দেখা দিল। লুদুর মা ছিল তার বাবার প্রথম স্ত্রী। এরা চার ভাইবোন ছিল। অন্য পক্ষেরও আরও নয়জন ছেলেমেয়ে ছিল। ফলে সংসারে ভীষণভাবে অভাব দেখা দিল।