দুপুর বেলা দেখা এক মওলানা সাহেবের সঙ্গে, কোরানে হাফেজ, তাঁর বাবাও খুব বড় পীর ছিলেন, কুমিল্লায় বাড়ি। হাজতিদের মধ্যে নামাজ পড়বার আগে বক্তৃতা করছেন, ওয়াজ করছেন, হাজতিরা বসে শুনছে। আমি দূরে দাঁড়াইয়া তার বক্তৃতা শুনছি। তিনি বলছেন খুব জোরে দরুদ শরীফ পড়। শয়তান দূর হয়ে যাবে। জোরে পড়। অনেকক্ষণ বক্তৃতা করলেন; সুন্দর চেহারা, অল্প বয়স, চমৎকার বলার কায়দা। তবে জামাটা খুব বড়। ঐটা দেখেই মনে সন্দেহ হলো। একদম পা পর্যন্ত জামা। বোধ হয় ছয় সাত গজ হবে কমপক্ষে। তজবি হাতেই আছে। মাঝে মাঝে চক্ষু বুজে কথা বলেন।
জিজ্ঞাসা করলাম, এই মওলানা সাহেব কি মামলায় এসেছেন। আমাকে এক ‘পাহারা’ বললো, জানেন না, ‘রেপ কেস’; একটা ছাত্রীকে পড়াতো তার উপর পাশবিক অত্যাচার করেছে, মসজিদের ভিতর। মেয়েটার ১২/১৩ বৎসর বয়স, চিৎকার করে উঠলে লোক এসে দেখে ফেলে। তারপর ধরে আচ্ছামত মারধর করে। জেলে এসে কয়দিন তো হাসপাতালেই থাকতে হয়েছে। আমি বললাম হাজতে এসে ধর্ম প্রচার শুরু করেছে। বেটা তো খুব ভণ্ড। জমাইছে তো বেশ।
‘সন্ধ্যার পরে আমাদের তালাবন্ধ করে দিয়েছে। আমাদের উপরের কোঠায় সেই হাফেজ সাহেব থাকতেন। মগরবের নামাজের পর চলল তার ‘মিলাদ অনেকক্ষণ, তারপর দরুদ, তারপর চলল কোরান তেলাওয়াৎ। তিনি যে কোরানে হাফেজ সেইটাই দেখাতে ব্যস্ত আছেন, বলে আমার মনে হলো। মামলায় তাঁর চার বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। তিনি দরখাস্ত করেছিলেন ডিভিশন পাওয়ার জন্য। যদিও তার গ্রামের রিপোর্টে জানা গিয়েছিল তিনি সম্মানী ঘরের থেকে এসেছেন। তবে তাকে ডিভিশন দেওয়া হয় নাই, কারণ তিনি পাশবিক অত্যাচারের অপরাধে অপরাধী।
ফরিদপুর জেল থেকে ফিরে এসে দেখলাম হাফেজ সাহেবকে ডিভিশনের কয়েদিরা এনেছেন তার কাছে কোরান পড়তে। আমার সাথে আলাপ হলো। জিজ্ঞাসা করলাম ‘এমন কাজটা করলেন ছাত্রীর সাথে, তাও আল্লাহর ঘর মসজিদের ভিতর।’ তিনি বললেন “মিথ্যা মামলা, এ কাজ আমি কোনো দিন করতে পারি?” তবে নিজকে নির্দোষ প্রমাণ করতে বেশি কথা বলে ধরা পড়ে গিয়েছিলেন আমাদের কাছে। অনেক মওলানা সাহেব মুরিদানদের বাড়িতে বেশি মুরগির গোশত খান। তাই শক্তিও বেশি, এজন্য এক বিবাহতে হয় না, তিনটা চারটা বিবাহ করেন। এটা এদের অনেকের পক্ষে স্বাভাবিক। কারণ কাজ কর্ম করতে হয় না, ভিক্ষার টাকাতেই সংসার করেন, তাই তাকত বেশি। আবার অনেক মওলানা মৌলবী সাহেবরা আছেন যারা কাজ করেন, পরের জন্যে দেওয়া অর্থ কড়ি নেন না, আর বিবাহও একটা করেন। কারণ তাদের মন পবিত্র।
ছোকরা দফা-জেলখানায় আর একটা দফা বড় ভয়ানক ব্যাপার। সেটা হলো ছোকরা দফা। অল্প বয়সের কয়েদি ও হাজতিদের এক জায়গায় রাখা হয়, আলাদা করে। সাধারণ কয়েদিদের কাছে রাখতে দেওয়া হয় না। খুব কড়াকড়ি করা হয়। ছোকরাবাজি জেলে বেশি হয়। অনেকে ২০, ১০, ১২.. ৫… ৭… ৪.. ৩ বৎসর জেল নিয়ে আসে। নওজোয়ান অনেক থাকে, নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে এই সমস্ত কুকর্ম করে বেড়ায়। রীতিমত টাকা পয়সা খরচও করে এবং ছোকরা রাখে। জোগাড় করে ছোকরাদের ভাল ভাল জিনিস খাওয়ায়। ছোকরাবাজিতে ধরা পড়লে খুব অপমানও করা হয়। একবার একটা ঘটনা আমার মনে পড়ে। একটা লোক ছোকরাবাজিতে ধরা পড়ে। তাকে কয়েদিরা মুখে কালি, গলায় জুতার মালা আর একজন লাঠি নিয়ে মারতে মারতে সারা জেল ঘুরায়। আমরা যেখানে ছিলাম সেখানে নিয়ে আসে। লোকটা উপরের দিকে চাইছে না, আমি তো প্রথমে বুঝতে পারি নাই-পরে জিজ্ঞাসা করলে একজনে বলল সমস্ত ঘটনা। বলল এতো কিছুই না, আরও অনেক মার ওর কপালে আছে। এ বিষয়ে কড়াকড়িও খুব বেশি, এ কাজ তা সত্ত্বেও চলে বেশি। তাই ছোকরা চাইলে সহজে কাউকে দেওয়া হয় না। মেট পাহারা সিপাহিরা কড়া নজরে রাখে।
আমরা যেখানে থাকতাম কিছুদিন আমাদের ঘরের পাশের ঘরে ছোকরাদের রাখা হতো। দিনে আমরা যেখানে বেড়াতাম সেখানেই ওরা বেড়াতো। ৬ বৎসর বয়স থেকে ১৫ বৎসর বয়স পর্যন্ত অন্তত পক্ষে তখন প্রায় ৫০ জন হাজতি কয়েদি ছিল। ছোট ছোট ছেলে ডাকাত বা চোরের দলে ‘খোজারু’ ছিল। এরা কারও বাড়িতে যেয়ে খোঁজ নিয়ে আসত। এদের ট্রেনিং দেওয়া হতো। কারও বাড়িতে চাকর থাকত, কয়েকদিন পরে পালাইয়া যেয়ে সমস্ত খোঁজ খবর দিত চোরের দলকে। আবার অনেকগুলি আছে পকেট মার। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। একটা ৮ বৎসরের ছেলে পকেট মারার জন্য তিনবার জেলে এসেছে। কিছুদিন জেল দেয়, ছোট ছেলে বলে ছাড়া পায়, তারপর আবার বাইরে যেয়ে পকেট মারে। পকেট মারের বড় দল আছে। ভাল ভাল শিক্ষিত অর্থশালী সর্দারও আছে। পকেট মেরে নিয়ে এক জায়াগায় ভাগ হয়। আবার কেহ কেহ একলাই করে।
একটা ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলে সে বললো, হুজুর কি যে বলেন, একদিনে আমার ব্যয় হয় ১০/১৫ টাকা, আমি কেন আর একজনের বাড়িতে কাজ করব। তার চাইতে ভাল একটা দান মারবো, থানায় কিছু দিব, চুপ হয়ে যাবে। যদি হাতেনাতে ধরা পড়ি তবেই তো বিপদ। পকেটমারের আর কয়দিন জেল হয়? এই সমস্ত ছেলেরা একবার জেলে আসলে এদের জেলের ভয় ভেঙে যায়। অনেক বুড়ালোক বহুদিন জেলে আছে, ছোট ছোট ছেলেদের দেখলে বোধ হয় তাদের নিজের ছেলেদের কথা মনে পড়ে, তাই এদের অনেককে খুব আদর করে, না খাইয়া খাওয়ায়। এদের স্নেহ পিতৃস্নেহ।