আমাকে গোপালগঞ্জ চালান দেওয়া হলো, কারণ সেখানে আর একটা মামলার আসামী—সেটা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের। গোপালগঞ্জ পৌঁছে খবর পেলাম, আমার মা-বাবা ও স্ত্রী ঢাকায় আমাকে দেখতে গেছেন। সাবজেলে আমাকে রাখা হলো না, কারণ জায়গা নাই; পাঠাইয়া দেওয়া হলো ফরিদপুর জেলে। মামলার তারিখ পড়ে গেছে। ফরিদপুর জেলে নিয়ে যাওয়া হলো। আমাকে ভাড়া দেওয়া হতো ইন্টারক্লাসের, নিজের টাকা দিয়ে সেকেন্ড ক্লাস করে নিলাম। সিপাহি বেচারারা কোনোদিন আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে নাই, খুবই আদর করেছে ও ভদ্র ব্যবহার করেছে। যে টাকা পথ খরচ সরকার দিতেন তাতে একবেলা খাওয়া হয়, স্টীমারে আর এক বেলা খাওয়া হতো না। তাই নিজের টাকা দিয়ে খেয়ে নিতে হতো।
ফরিদপুর জেলে এসে একলা পড়লাম। রাজবন্দিরা আছে। তাদের আলাদা জায়গায় রাখা হয়েছে। আর আমাকে রাখা হয়েছে একলা এক জায়গায়। হাসপাতালের একটা রুম ছেড়ে দিল, সেখানেই থাকলাম। প্রথমে হাসপাতাল থেকে খাবার দিত, পরে অন্য নিরাপত্তা বন্দিরা চার পাঁচজন এক জায়গায় থাকত, তারা নিজেদের পাক দেখাশোনা করত। আমাকে পরে সেখান থেকে খাবার আনাইয়া দেওয়া হতো। আমাকে ফরিদপুর জেলায় আনার পরে কাজ দেওয়া হলো, সুতা কাটা, কারণ এখন আর আমি রাজবন্দি নই, কয়েদি। সুতা কাটতে হতো। আর কয়েদির কাপড় পরতে হতো। তিন মাস খেটে ফেললাম, আমারও সাজা খাটা হয়ে গেল। আবার রাজনৈতিক বন্দি হয়ে গেলাম।
কিছুদিন পরে খবর পেলাম আমি আপীলে খালাস হয়ে গেছি। সাজাও খাটা হয়ে গেছে, আবার আপীলেও খালাস হলাম। এত কথা লেখা দরকার হতো না। একই জেলে আরও রাজবন্দি আছে, তারা এক ঘরে থাকে, তাদের সামনেই পাক হয়। আর আমাকে সেই একই জেলে একাকী থাকতে হচ্ছে। দোষ কি জানি না। জেলের আইন ভঙ্গ করি নাই, তবুও একাকী থাকতে হচ্ছে। তবে মাসে শুধু একবার গোপালগঞ্জ যেতে হয় ফরিদপুর থেকে। স্টিমার, নৌকা, গাড়িতে বেশ একটু ভোলা বাতাস খাইতাম। যদিও কথা বলা নিষেধ, তবু আস্সালামুআলাইকুম তো নিষেধ না। আমাকে কিছু কিছু মানুষ চিনতো। তাই সকল জায়গায়ই কিছু চেনাশোনা মানুষ পাওয়া যেতো, আস্সালামুআলাইকুম করেই শেষ করতাম, তা না হলে সিপাহিদের চাকরি যাবে। কারণ আইবি কর্মচারীও আছে। একবার আমাকে কে যেন মিষ্টি দিয়েছিল মাদারীপুর স্টেশনে। সেই মিষ্টি কেন আমি খেলাম তাতে সিপাহিদের কৈফিয়ত দিতে দিতে জান সারা হয়ে গেছে। একজন নাকি সাসপেন্ড হতে যাচ্ছিল, হাত পাও ধরে বেঁচে গেছে তাই ওদের জন্য কারও সাথে আলাপও করতাম না। যদি কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করত বলতাম, আমি কয়েদি, কথা বলা নিষেধ। আমার জন্য ওদের ক্ষতি হবে কেন!
‘আইন দফা’-জেলে একটা আইন দফা ছিল। এইটাই হলো সকলের চেয়ে কষ্টকর দফা। একটু মেজাজ দেখানো কয়েদি হলেই, সাজা দেওয়ার জন্য আইন দফা পাশ করা হতো। এদের গরুর মতো ঘানিতে ঘুরতে হতো। আর একটা পরিমাণ ঠিক ছিল, সেই পরিমাণ তেল ভেঙে বের করতে হতো। পিছনে আবার পাহারা থাকত, যদি আস্তে হাঁটতে অমনি পিটান। এটা ইংরেজ আমলেই বেশি ছিল, তবে পাকিস্তান হওয়ার পরে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত চলে। সেন্ট্রাল জেলে এটা বন্ধ হয়ে যায় ১৯৪৯ সালে; তবে জেলা ও সাবজেলে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত চলে। শক্তিশালী লোকগুলি ঘানি টেনে এক বছরের ভিতর এত দুর্বল হয়ে পড়তো যে সে কথা কি বলব!
আমি যখন ফরিদপুর জেলে যাই তখন দেখতে পেলাম মানুষ দিয়ে ঘানি ঘুরাইয়া তেল বাহির করা হয়। একদিন জেলার সাহেবকে আমি বললাম, ‘সরকার হুকুম দিয়েছে কয়েদি দিয়ে ঘানি ঘুরানো চলবে না, আপনার জেলে এখনও চলছে কেন? তিনি বললেন ‘২/১ দিনের মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হবে, গরু কিনতে হুকুম দেওয়া হয়েছে। উপরে লিখেছি, অনুমতি এলেই কয়েদিদের পরিবর্তে গরু দিয়ে করা হবে। সত্যই জেলার সাহেব আমি থাকতেই বন্ধ করে দিলেন। না দিলে হয়তো আমার প্রতিবাদ করতে হতো অথবা সরকারের কাছে দরখাস্ত করতে হতো। একটা লোক ঘানি ঘুরাতে ঘুরাতে অসুস্থ হয়ে একবার হাসপাতালে ভর্তি হলে তাকে কষ্টের কথা আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম। সে বলেছিল, হুজুর দিনভরে গরুর মতো ঘুরে রাতে যখন শুতে যাইতাম তখনও মনে হতো ঘুরছি, ঘুমাতে পারতাম না, দেখেন সেই যে শরীর নষ্ট হয়ে গেছে আর ভাল হয় নাই। খোদা আপনাকে বাঁচাইয়া রাখুক, আপনি জেলে না আসলে আর কতদিন যে গরুর মতো ঘুরতে হতো বলতে পারি না।
জেলখানায় কথা এক মিনিটে প্রচার হয়ে যেতো।
ডালচাকি দফা-ডালচাকি নামে একটা দফা আছে। এদের ডাল ও গম ভাঙতে হয়। আজও আছে এটা। ডাক্তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে দেয়। যাদের ‘good’ মার্কা স্বাস্থ্য তাদের রোজ একমন করে ডাল ভাঙতে হয়, আর যাদের স্বাস্থ্য মিডিয়াম’ তাদের আধামন ডাল রোজ ভাঙতে হয়। গমও ভাঙতে হয়। প্রত্যেকের রোজ দশ সের করে গম ভাঙতে হয়।
হাজতি দফা-এখানে হাজতিদের রাখা হয়—যাদের জামিন হয় নাই, মামলা চলছে। ঢাকা জেলে তিনতালা একটা দালানে এদের রাখা হয়। ছয়টা রুম আছে। কোনো লোক যখন হাজতে থাকে-যার মামলা চলতে থাকে, তখন সমস্ত রাত কারও ঘুমাবার উপায় থাকে না। রাত ভরে নামাজ, জেকের, মিলাদ। তজবি জপে ‘আল্লাহু আল্লাহু’ করতে থাকে।
১৯৪৯ সালে আমাকে গ্রেপ্তার করে সকালে জেলে এনে হাজতে রাখলো; কারণ আমাকে ডিভিশন দেওয়া হয় নাই। আরও কয়েকজন রাজবন্দি ছিল নিচের একটা রুমে। তাদের কাছে আমাকে রাখা হলো। আরও হাজতিও ছিল সেই রুমে। খাবার দিল ডাল, একটা তরকারী, আর ভাত—কি আর করা যাবে, খুব ক্ষুধার্ত ছিলাম—খেয়ে নিলাম। যা পাক করেছে, তেলের গন্ধ, ময়লা–বিশেষ করে চাউলের ভিতর কাঁকর, ডাল দিয়ে চারটা মুখে দিলাম। জান তো বাঁচাতে হবে।