অনেক সত্য ঘটনা আমি দিবার চেষ্টা করব—যাতে বুঝতে পারা যাবে, কেমন করে জেলে আসার পরে খাবারের অভাবে স্ত্রী তালাক দেয়া হয়। একটা না, বহু ঘটনা আছে। প্রথম প্রথম জেলে এসে অনেক কথা বুঝতেই আমার কষ্ট হতো, যেমন একদিন এক, ‘পাহারা এসে বলল তার সিকম্যান’ যেতে হবে। আমি তার মুখের দিকে চেয়ে আছি, কিছুই বুঝতে পারি না। জিজ্ঞাসা করলাম, সিকম্যান’ কিরে? বলে হুজুর ‘সিকম্যান’ জানেন না, যেখানে ওষুধ পাওয়া যায়, আমার যেতে হবে ওষুধ আনতে। আর কোনো কথা না বলে চুপ করে রইলাম। বুঝলাম, এসব জেলের নিজস্ব ভাষা, আমি বুঝতে পারবো না।
ডিভিশন কয়েদি ছিল বরিশালের বারী সাহেব ও ওহাব সাহেব। আমরা এক সাথেই থাকতাম। বারী সাহেব হাসপাতালে রাইটারের কাজ করতেন আর ওহাব সাহেব ফ্যাক্টরীতে রাইটারের কাজ করতেন। দুইজন খালাতো ভাই। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। প্রায় আট বছর জেলে আছে। জমিজমার ব্যাপারে একটা খুন হয়ে যায়। তার দণ্ড এই জেল। ওহাব সাহেব একটা ছেলে রেখে এসেছে। জোয়ান সুপুরুষ। বিধবা মা ছিলেন, মারা গেছেন জেলে আসার পর। মাত্র স্ত্রী আর ছেলেটা, এক বছরের রেখে আসছে আর দেখা হয় নাই। বারী সাহেবের ছেলেমেয়ে আছে, মেয়েটার বিবাহ হয়েছে জেলে আসার পরে। খুব চিন্তিত থাকেন সকল সময়। কোনো রকমের কথাবার্তায় উত্তর নাই, গোলমালের ভিতর নাই। চুপচাপ থাকেন। ওহাব সাহেব ভীষণ গোয়ার লোক, রাগ হয়ে যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। এরা যখন কাজ করে ফিরে এলেন তখন, সিকম্যানের কথা জিজ্ঞাসা করলাম। বারী সাহেব বললেন, ‘সিকম্যান’ মানে হাসপাতাল, কয়েদিরা সিকম্যান বলে। বুঝলাম ব্যাপারটা।
জেলখানায় হাসপাতাল আছে, পূর্বেই বলেছি। সেন্ট্রাল জেলে, বিশেষ করে ঢাকা জেলে ভাল হাসপাতাল। দোতলা দালান, প্রায় একশ’ রোগীর স্থান হতে পারে, তিনজন ডাক্তার আছে, একজন কম্পাউন্ডার, সপ্তাহে দুইবার সিভিল সার্জন আসেন। তারই চার্জে জেল হাসপাতাল। ঔষধ যথেষ্ট থাকে, ডাক্তারের হুকুম মতো যে কোনো খাদ্য কয়েদিদের দিতে বাধ্য। একে ‘মেডিকেল ডাইট’ বলা হয়। কয়েদিদের ওজন কম হয়ে গেলে ডাক্তাররা ‘ডাইট’ দিয়ে থাকেন, তবে সকল ডাক্তার না। হাসপাতালে চিকিৎসাপ্রাপ্ত হয়ে যদি রোগ ভাল না হয়, তবে জেলের মেডিকেল অফিসার ইচ্ছা করলে মেডিকেল কলেজে পাঠাতে পারে। দুঃখের বিষয় কয়েদিদের কপালে ভাল ঔষধ কম জোটে। কারণ ভাল ব্যবহারের ডাক্তার যারা—যারা কয়েদিদেরও মানুষ ভাবে, আর রোগী ভেবে চিকিৎসা করে, তারা বেশিদিন জেলখানায় থাকতে পারে না।
অনেক ডাক্তার দেখেছি এই জেলখানায় যারা কয়েদিদের ‘ডাইট’ দিতে কৃপণতা করে না, অসুস্থ হলে ভাল ঔষধ দেয়। আবার অনেক ডাক্তার দেখেছি যারা কয়েদিদের কয়েদিই ভাবে, মানুষ ভাবে না, রোগ হলে ঔষধ দিতে চায় না। পকেটে করে ঔষধ বাইরে নিয়ে বিক্রি করে। ঘুষ খায়, চিকিৎসা করার নামে। আবার টাকা পেলে হাজতিদের মাসের পর মাস হাসপাতালে ভর্তি করে রাখে, ব্যারাম নাই যদিও। এভাবে বাইরের থেকে জামিনের চেষ্টা করা যায়। ম্যাজিষ্ট্রেট যখন জেলখানায় দেখতে যায় কয়েদিদের অবস্থা, তখন হাসপাতালে অসুস্থ অবস্থায় ভর্তি দেখায়ে দেয়। এতে জামিন পেয়ে যায়। বাইরে থেকে বিচারাধীন আসামীর কেউ হয়তো কোনো ডাক্তারের সাথে দেখা করে টাকা পয়সা দিয়ে গেছে, বলে গেছে জামিন হলে আরও দেব। যার অসুখ নাই তাকে মাসের পর মাস হাসপাতালে সিট দিয়ে রেখে দিয়েছে, আর যে সত্যিই রোগী তার স্থান নাই। এটা বাইরেও হয়ে থাকে, শুধু জেলে না, তবে এখানে একটু বেশি হয়।
আবার এমন ডাক্তার দেখেছি যারা জেলখানায় পানিও মুখে দেয় না, ঘুষ তো দূরের কথা। রোগীদের ভালভাবে চিকিৎসা করে, রাতদিন পরিশ্রম করে। আবার এমন ডাক্তার জেলে দেখেছি, সুন্দর চেহারা, মুখে দাড়ি, নামাজ পড়তে পড়তে কপালে দাগ পড়ে গেছে-দেখলে মনে হয় একজন ফেরেস্তা। হাসপাতালের দরজা বন্ধ করে কয়েদিরোগীদের ডাইট থেকে ডিম, গোস্ত, রুটি খুব পেট ভরে খান, আর ঔষধও মাঝে মাঝে বাইরে নিয়ে বিক্রি করেন।
হাসপাতালে রোগীদের জন্য আলাদা পাক হয়। এখানটায় হলো খাওয়ার আড্ডা। কয়েদিরা কথা বলতে সাহস পায় না, তাই তাদের মুখের গ্রাস অনেকেই খেয়ে থাকেন। একজন ডাক্তারকে আমি জানতাম, মুখে খুব ভদ্রলোক। আসতে সালাম, যাইতে সালাম, খবর নিয়ে জানলাম তিনি এক প্যাকেট সিগারেটও ঘুষ খান।
জেলে কোনো ঘটনা চাপা থাকে না। যে কোনো ঘটনা জেলখানায় আধা ঘণ্টার ভিতর আড়াইহাজার কয়েদির কানে চলে যাবে।
আমাকে ও মওলানা সাহেবকে মেডিকেল ডাইট’ বাঁচাইয়া রেখেছিল দ্বিতীয়বার। পরে খবর নিয়ে শুনলাম, নুরুল আমিন সাহেব নাকি জেল সুপারেনটেনডেন্ট সাহেবকে বলে রেখেছিলেন যে আমাদের যেন কোনো খাওয়ার, থাকার কষ্ট না হয়। সেজন্য বোধহয় একটু যত্ন পেয়েছিলাম।
পাকিস্তান হওয়ার পরে রাজবন্দিদের যে সমস্ত সুযোগ সুবিধা ইংরেজ আমলে ছিল তাহা উঠাইয়া দেওয়া হয়। রাজবন্দিদের কোনো বিশেষ সুবিধা দেওয়া হতো না। তাদের ব্যবহার করা হতো সাধারণ কয়েদিদের মতো। কাহাকেও তৃতীয় শ্রেণীর মতো ব্যবহার করত, আবার কাহাকেও প্রথম শ্রেণীর মতো ব্যবহার করত। আইবিদের ইচ্ছা। আমার মনে আছে, এক এমবিবিএস ভদ্রলোক ডাক্তারকে তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদি করে দুই বৎসর রাখা হয়েছিল। আমার এক ভাগ্নে মেডিকেল কলেজে পড়তে যাকে গ্রেপ্তার করে তৃতীয় শ্ৰেণীর কয়েদি করে জেলে রাখা হয়েছিল আমার চোখের সামনে। ওর দিকে আমি চাইতে পারতাম না। দু’একবার জেল পালানো বা জেলের আইন মানে , মারপিট করে-ডেঞ্জারাস কয়েদিদের রাখা হতো যেখানে সেই জেলে তাকেও রাখা হয়েছিল। আমাকেও দুই-চারবার এই সমস্ত সেলে থাকতে হয়েছে। তাই রাজবন্দিরা মেডিকেল ডাইট না পেলে তাদের স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যেত। কিন্তু সকল সময় তাদের কপালে তা জুটতো না। হাসপাতালে রাজবন্দিদের ভর্তি করলে তাড়াতাড়ি রোগ ভাল হোক আর খারাপ হোক, সেদিকে খেয়াল না করে তাড়াইয়া দেওয়া হতো। ডাক্তাররা ইচ্ছা করলে কয়েদিদের যথেষ্ট সাহায্য করতে পারে। যত রকম রোগ আমরা সাধারণ মানুষ জানি তা জেলখানায় আছে। টিবি রোগীকেও রাখার ও চিকিৎসা করার বন্দোবস্ত জেলের ভেতর করা আছে।