ঠাকুরপো, আজ আমার ঘরে কেউ আসবে না। কেউ না। আজ মৃত্যুব্রত পালন করছি আমি। একই সঙ্গে বেদনা আর আনন্দ বাজছে হৃদয়ে আমার। আজ আমার নির্জলা উপবাস—যাতে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ি আমি, যাতে মরতে তেমন কষ্ট না হয়।
আবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে ভাবনা। ঝিমঝিম করছে মাথার মধ্যে। তবু লিখছি। আমি যে লিখছি তা ঠিক নয়। কেউ একজন লিখিয়ে নিচ্ছে এসব কথা আমাকে দিয়ে। মনে পড়ে গেল কয়েক বছর আগের কথা। কিন্তু তার আগে অন্য একটা কথা তোমাকে বলি। খুব তেষ্টা পাচ্ছে। আমার। ঘরের কোণে পাথরের টেবিলটার ওপর কুঁজো ভরতি জল। কিন্তু এক ফোঁটাও জল খাব নাযতই তেষ্টা পাক। জল খেলেই আমার ব্রত যে ভেঙে যাবে। বরং টেবিলের ওপর মাথা রেখে একটু জিরিয়ে নিই ঠাকুরপো-মাথাটা এত ঝিমঝিম করছে কেন বলো তো?
০৪. সামান্যই ঘটনা, তবু মনে পড়ে গেল
সামান্যই ঘটনা, তবু মনে পড়ে গেল। গত চারমাস শুধু এইরকম কত ঘটনা মনে করে-করে বেঁচে থাকলাম আমি। শুধুই স্মৃতির মধ্যে বেঁচে থাকা। বর্তমান যেন থেমে গিয়েছে আমার জন্যে। শুধু মনে পড়ে, মন কেমন করে, অতীতই হয়ে ওঠে বর্তমান বেঁচে ছিলাম সেইভাবেই। তোমার বিয়ের পরে চারটে মাস আমার কেটেছে অতীতে। ক্রমশ মনে হল, কী লাভ অতীতের মধ্যে বেঁচে থেকে। এরচেয়ে মরে যাওয়াই তো ভালো।
যে-ঘটনার কথা বলতে যাচ্ছিলাম—একদিন বিকেলবেলা জানলার ধারে চুপ করে বসে মালা গাঁথতে-গাঁথতে ঘুমিয়ে পড়েছি, তুমি এলে আমার ঘরে।
আমার উড়ুক্কু চুলগুলি কপাল থেকে সরিয়ে আমার পিঠের ওপর হাতটি রেখে নরম করে ডাকলে, নতুনবউঠান।
আমি তাকালাম তোমার পানে। তুমি বললে, যেভাবে এ-ভুবনে শুধু তুমিই বলতে পারো, মনে হল কবিতা, মনে হল গান, মনে হল প্রেম—আমাকেই নিবেদন করলে তুমি।
ভেবেছিলাম হয়তো বা ভুলে গেছি। কিন্তু ভোলা কি যায় ঠাকুরপো। তোমার কথাগুলি যে ঝরে পড়ছিল ফুলের মতো আমার মনোভূমিতে।
তুমি বললে, ‘নতুনবউঠান, মালা গাঁথতে-গাঁথতে জানলার কাছে বসে কার কথা ভাবছ অমনভাবে করতলে রাখি মাথা? তোমার কোলে ফুল পড়ে রয়েছে, তুমি ভুলে গেছ মালা গাঁথা!’ ঠাকুরপো, তোমার হাতটিকে আমার গালের উপর চেপে বলেছিলাম, ‘তোমারই জন্যে মালা গাঁথছি ঠাকুরপো, তোমারই কথা ভাবতে-ভাবতে ভুলে গেছি মালা গাঁথতে। ‘
তুমি বললে, ‘আমার কথা ভেবে মালা গাঁথতে ভোলোনি। ভুলেছ ওই যে ঝুরু ঝুরু বায়ু বহে যায় আর কানে কানে কী যে কহে যায়—সেই জন্যে। ওই যে চোখের ওপর ভেসে যাচ্ছে মেঘ, উড়ে যাচ্ছে পাখি আর সারাদিন ধরে বকুলের ফুল ঝরে পড়ছে থাকি-থাকি, ভুলেছ সেই জন্যে।
আমি তোমার কথা শুনে কেমন বিহ্বল হয়ে গেলাম। তুমি আমার আদ্দেক গাঁথা মালাটি নিলে আমার কোল থেকে তুলে। দিলে আমার বেণীর সঙ্গে জড়িয়ে। তারপর একটু নীচু হয়ে কানের কাছে মুখ এনে বললে, ‘নতুনবউঠান, লোভন হয়েছে গ্রীবাটি তোমার। ‘ আচমকা তোমার ঠোঁট আদর করল আমার উন্মুখ গ্রীবা। তুমি আমার কানে-কানে বললে, ‘নতুন বউঠান, তোমার এই মধুর অলস, এই মধুর আবেশ, মধুর মুখের এই হাসি—আমার প্রেমের মধ্যে থেকে গেল তাদের মূল্যের পরিমাণ। ‘
ঠাকুরপো, আমার হাসি, যার জন্যে তুমি সত্যিই পাগল হয়ে গিয়েছিলে একদিন, সেই হাসি দেখার জন্যে তোমার কত না কথা, কত দুষ্টুমি, ফন্দি, কৌতুক,—সত্যি করে বলো ঠাকুরপো সেই হাসির কথা তোমার আজও মনে পড়ে?
তুমিই তো একদিন আমাকে বলেছিলে, ‘ধীরে ধীরে প্রাণে আমার এসো হে, মধুর হাসিয়ে ভালোবেসো হে। ‘ সেই গান আর একদিন তোমার নতুন বউয়ের দিকে তাকিয়ে তুমি গাইতে পারলে! মনে পড়ে, দক্ষিণের বারান্দায় সেদিন কেউ ছিল না। শুধু তুমি আর আমি। বিকেলবেলা গা ধুয়ে ছাদে যাওয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছি, তুমি এলে ছুটে। আমার চিবুক ধরে মুখটি তুলে ধরলে। আমার দৃষ্টি আটকে গেল তোমার চোখে।
তুমি কী বলেছিলে ভুলিনি। বলেছিলে, ‘তোমার এই চকিতের চাউনির দান সংসারের আর সমস্তকে ছাড়িয়ে আমারই হাতে এসে পৌঁছেছে। নতুনবউঠান, একে আমি রাখব গানে গেঁথে, ছন্দে বেঁধে। আমি একে রাখব সৌন্দর্যের অমরাবতীতে। ‘
আমি বললাম, ‘ঠাকুরপো, আমার চোখের জলে সেই অমৃত নেই যাতে এক নিমেষের চাউনিকে চিরকাল বাঁচিয়ে রাখতে পারে। মেঘের সকল সোনার রং যে-সন্ধ্যায় মিলিয়ে যায়, একদিন সেই চাউনিও সেই সন্ধ্যায় মিলিয়ে যাবে। হাজার কথার আবর্জনা, হাজার বেদনার স্তুপে তুমি। আজকের এই মুহূর্তটিকেও হারিয়ে ফেলবে একদিন। ‘
তুমি আমার কথার উত্তরে তেমন কিছুই বললে না। বললে অনেক রাতে, ছাদের অন্ধকারে। কী বলেছিলে আজ তোমার মনে নেই। বলেছিলে, ‘নতুনবউঠান, আমি চাইনে রাজার প্রতাপ। আমি চাইনে ধনীর ঐশ্বর্য। তোমার চোখের মায়াই আমার চিরদিনের ধন। তাই দিয়েই আমি অসীমের গলার হার গাঁথি।
বন্ধু, কত কথা যে মনে পড়ছে। যত এগিয়ে আসছে সময়, ততই যেন কোনও কোনও মুহূর্তকে। আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে। আবার এই মুহূর্তগুলোর জন্যই বেঁচে থাকার কষ্ট আর সহ্য করার শক্তি নেই আমার। মনে পড়ছে সেই দুপুরবেলাটি। বৃষ্টি পড়ছে সকাল থেকে। কখনও-কখনও কমে আসছে বৃষ্টি। আবার দমকা হাওয়া তাকে মাতিয়ে তুলছে।
ঘরে দিনের বেলাতেই বাতি জ্বালিয়ে রেখেছি। হাওয়ার দাপটে কাঁপছে তার শিখা। কিছুতেই কাজে মন যাচ্ছে না। হঠাৎ তুমি তোমার ঘরে বর্ষার গানে লাগালে মল্লারের সুর।