ঠাকুরপো, ঠাকুরবাড়ির রূপকুমার, সত্যিই রূপেগুণে জ্যোতির্ময় স্বয়ং জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী হওয়ার কোনও যোগ্যতাই ছিল না আমার কোনওদিন সেই যোগ্যতা অর্জন করতেও পারিনি, তবু কেন তাঁর সঙ্গে বিয়ে হল আমার? সেই কথাটা কেউ কিন্তু ভেবেও দেখল না। ঠাকুরপো,। আমার সঙ্গে বিয়ে না হলে তোমার নতুনদাদার বিয়েই যে হত না। আমিই ছিলাম তোমাদের সবচেয়ে সহজ মুক্তির উপায়, হাতের কাছেই ছিলাম আমি, তোমাদেরই বাড়ির গরিবমহলে, নীচের তলায়। কে বাবামশায়ের কানে আমার কথাটা তুলেছিল জানি না। আমার ভাগ্য, আমার নিয়তি। বাবামশায়ের আদেশ গেল তোমার নতুনদাদার কাছে, আমাকে বিয়ে করার জন্যে। তখন যে সূর্যকুমারের মেয়ের কথা তাঁকে জানানো হয়নি, তা হয়তো নয়। কিন্তু তিনি কান দিলেন না। আমার মতো সহজলভ্য আর কে ছিল বলো?
ঠাকুরবাড়ির পুরুষ—সে-পুরুষ যতই হোক রূপবান, গুণবান, যেমন তোমার জ্যোতিদাদা, যেমন তুমি নিজে,—সেই পুরুষের বউ পাওয়া খুব সহজ নয়। ঠাকুরপো, মাত্র চারমাস তোমার বিয়ে হয়েছে। এখন তুমি তোমার নতুন বউ নিয়ে বেশ আচ্ছন্ন—তাই তো স্বাভাবিক। পুরাতনকে বিদায় জানিয়েছ তুমি। নতুনই তোমার সব। কিন্তু একদিন তোমারও মনে হবে ঠাকুরপো, তুমি সেই বাবামশায়ের নির্দেশেই বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছ অনেক নীচের তলায়। তোমার স্ত্রীর বাবা ঠাকুরবাড়িরই কর্মচারী, তোমার যোগ্য স্ত্রী কি তুমি পেলে ঠাকুরপো?
অর্থ, আভিজাত্য, রূপ-গুণ কোনও কিছুর জন্যেই হিন্দু ঘরের তেমন মেয়ে তোমাদের ঘরে আসবে না—যে মেয়ে বংশ-মর্যাদায়, শিক্ষাদীক্ষায় তোমাদের সমান-সমান। কারণ তোমরা তো হিন্দুনও। ব্রাহ্ম। যে-শালগ্রাম শিলা সাক্ষী রেখে হিন্দু বিয়ে হয়, সেই শালগ্রাম শিলাই তোমরা মানো না! তার ওপর তোমরা আবার মুসলমানের জল খাওয়া একঘরে পিরালি ব্রাহ্মণ! এক কথায়, তোমাদের কোনও হিন্দুব্রাহ্মণ পরিবারইব্রাহ্মণ ভাবে না। সুতরাং সেই পরিবার তোমাদের চট করে মেয়ে দেবে কেন?
আমার পরম সৌভাগ্য কিংবা অমোঘ নিয়তি, আমাকে তোমরা পেয়ে গেলে হাতের কাছে। আমার বাবার তো আর না বলার ক্ষমতা নেই। স্বয়ং বাবামশায়ের আদেশ—তোমার জ্যোতিদাদারই প্রতিবাদ করার সাহস হল না। আমার বয়েস তখন মাত্র নয়। তিনি উনিশ। বিদ্যায়-বুদ্ধিতে কত এগিয়ে আমার চেয়ে। সত্যিই তো, কত বড় ভাগ্য আমার—বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিড়ল, কোনও যোগ্যতা ছাড়াই ঠাকুরবাড়ির বউ, স্বয়ং জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী হয়ে গেলাম আমি—শুধুমাত্র আমার সহজলভ্যতার যোগ্যতায়, শুধুমাত্র তোমাদের কনে খোঁজার পরিশ্রম সহজে মিটিয়ে দিতে।
রবি, আমার প্রাণের রবি—আমার সব দুঃখ, সব পরাজয় আর অপমান একদিকে। আর একদিকে তুমি। ঠাকুরবাড়িতে আমার একমাত্র পাওয়া তুমি, তুমি ঠাকুরপো, শুধু তুমি। ন’বছর বয়সে এ-বাড়িতে এসে তোমাকে পেলাম আমার খেলার সাথি, আমার দোসর। বালিকাবেলা থেকে যখন পৌঁছলাম কৈশোরে, যখন আমার শরীর-মন হয়ে উঠল অন্যরকম, যখন বদলে গেল আমার ইচ্ছের রং, তোমাকে তখন পেলাম আমার বন্ধু। আমার একমাত্র বন্ধু। আমার প্রতি। ঠাকুরবাড়ির সমস্ত অবহেলা, সব চাপা ঘেন্নার যেন প্রতিশোধ নিলে তুমি আমার পরম পুরুষ। যদি কেউ কখনও বুঝে থাকে আমার দহন, সে তুমি। আমার মনে আছে, নন্দনকাননে অন্ধকার রাত্তিরবেলা আমাকে জড়িয়ে ধরে তুমি বললে, নতুন বউঠান, কী তোমাকে দহিছে, আমি জানি। তোমার মতন করে কথা বলতে এ-বাড়িতে কেউ পারে না। তোমার কথা শুনে, তোমার বুকের আশ্রয়ের মধ্যে সে-রাতে আমার মনে হয়েছিল, সত্যিই আমার অন্তরের সব জ্বালা-যন্ত্রণা জুড়িয়ে বৃষ্টি এল। মনে হয়েছিল—তুমি আমার চিরকালের। মনে হয়েছিল, না না বিশ্বাস হয়েছিল ঠাকুরপো-তোমার ওই মন, যেমন বোঝে আমার অপমান, যে মন অনুভব করে আমার একাকিত্ব, যে মন সব সময়ে ছুঁয়ে থাকে আমার মন—সেই মনটাকে আমি চিরকালের জন্যে পেয়েছি। সেই মনের ওপর আর কোনও অধিকার নেই—এই বিশ্বাসের জোরেই আমি বেঁচেছিলাম।
ঠাকুরপো, মনটা আবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই বাগে আনতে পারছিনা। কখন যে আমার জীবনের শেষ দিনের এতটা সময় কেটে গেল! এখন দুপুরবেলা, আমার ঘরের জানলা দিয়ে দেখতে পেলাম বামুনঠাকুর তোমাদের ঘরে দিয়ে গেল মধ্যাহ্নের খাবার—তুমি আজকাল তোমার নতুন বউকে নিয়ে নিজের ঘরেই খাও। তোমার নতুন জীবন এই চারমাসে কত বদলে দিয়েছে তোমাকে। আগে আমার হাতের রান্না ছাড়া তোমার মন ভরত না। কিছু না কিছু রাঁধতেই হত তোমার জন্যে। এখন বামুনঠাকুরের রান্নাতেই তুমি খুশি। তোমার জ্যোতিদাদা অবিশ্যি এবাড়ির রান্না মুখে দেন না। তিনি থাকেনই বা কখন যে খাবেন? ভুলেই গেছি কবে তাঁকে। দেখেছি। তিনি মেজবউঠাকরুণের বাড়িতে বেশি আরাম পান—ওঁদের বাড়ির সাহেবি রান্নাতেই তাঁর তৃপ্তি বেশি।
ঠাকুরপো, আমার আজ উপোস। রান্নাঘরে সে-খবর পাঠিয়ে দিয়েছি সকালবেলা। আজ আমার দরজা বন্ধ। এ-দরজা আমি বন্ধ করেছি। খুলব না আমি। তোমরা খুলো—আমার মৃত্যুর পরে। সেই রুদ্ধদুয়ার খোলার অভিজ্ঞতা থেকে হয়তো তোমার মধ্যে জন্ম হবে কোনও লেখা। কোনওদিনকে বলতে পারে! আমি থেকে যাব তোমার সেই লেখার আড়ালে।