আমার রবি, কতই বা তখন বয়েস হবে তোমার। তখন তো তুমি একরত্তি বালক, বয়েস এই সাতটাত হবে। আমার কিন্তু তখন বেশ বয়েস, আমার বিয়ের দিনেই তো আমি নয়ে পড়লাম। ১৮৬৮-র ৫ জুলাই ছিল আমার ন’বছরের জন্মদিন। হিন্দুরা বলে, জন্মদিনের দিন বিয়ে করতে নেই। তা, তোমরা তো হিন্দুনও, ব্রাহ্ম। ওসব কুসংস্কার তোমাদের নেই। তবে আসল কথাটা। হল, সেদিন যে আমার জন্মদিন, সে কথাটা কেউ মনেও রাখেনি। ওই দ্যাখো, এবার মনে পড়ল। আমার মায়ের কথা, ওই তো আমি দেখতে পাচ্ছি, আবছা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক কোণে, বলছেন জন্মদিনে বিয়ে দিলে সে-বিয়ে শুভ হয় না। ঠাকুরপো, এবার সব মনে পড়েছে আমার মায়ের নাম ত্রৈলোক্যসুন্দরী। যাঁর কথা কেউ শুনল না, আমার বিয়েতে যাঁর কোনও ভূমিকাই নেই, ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে যাঁর কোনও পরিচয় নেই তাঁর কত বড় নাম—ত্রৈলোক্যসুন্দরী। কোথায় হারিয়ে গেলেন চারকন্যার সেই জননী, আমার মা। আমার ঠাকুরদা জগন্মোহন গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন ঠাকুরবাড়ির দারোয়ান। তোমাদের বাড়ির ফটকেই তাঁর চিরস্থায়ী আসন ছিল পাতা। আমার দাদামশাইয়ের নাম শশিভূষণ মুখোপাধ্যায়। ঠাকুরবাড়িতে তাঁর কোনও পরিচিতিই নেই।
এই দ্যাখো! আবার পিছলে গেছে আমার লেখা। যেকথা বলছিলাম, ১৮৬৮-র ৫ জুলাই, আমার জন্মদিনে তোমার উনিশ বছরের নতুনদাদার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গেল। কী দুর্লভ সৌভাগ্য। আমার, ঈশ্বরের কত বড় আশীর্বাদ আমার ওপর, আমি, যার বিদ্যে তখন প্রথম ভাগও পেয়নি, আমি এক গরিবের কালো রোগা মেয়ে, হয়ে গেলাম ঠাকুরবাড়ির বিদ্বান, অপূর্ব রূপবান, অভিজাত যুবক, গানে-বাজনায়-লেখায় সরস্বতীর বরপুত্র স্বয়ং জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী!
প্রায় প্রথম দিন থেকে শুরু হয়ে গেল আমাকে তোমার নতুনদাদার যোগ্য করে গড়ে তোলার চেষ্টা। আমার জন্যে কেনা হল প্রথম ভাগ, দ্বিতীয় ভাগ, ধারাপাত। আমাকে ঘষেমেজে তৈরি করার দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিলেন মেজবউঠাকরুণ জ্ঞানদানন্দিনী। আমার মোটেই ভাল্লাগতো না এসব। ভাল্লাগতো শুধু তোমার সঙ্গে ধারাপাত পড়তে। তোমার সঙ্গে প্রথম বাঁধা পড়েছিলাম ধারাপাতের সুরে।
প্রাণের রবি, আমি ক্রমশ হয়ে উঠলাম তোমাদের বাড়ির বউ। আমার একমাত্র পরিচয়, আমি তোমার নতুনদাদার স্ত্রী। তুমি আমাকে কী মিষ্টি করে ডাকলে নতুনবউঠান। আমার জীবনে সারা দিনরাত ধরে একটাই চেষ্টা—কী করে হয়ে উঠব জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের যোগ্য স্ত্রী!
আমার বাবা-মা পড়ে থাকলেন, আমার দৃষ্টিপথ থেকে অনেক দূরে, তবু একই বাড়ির বারমহলে—আমি যে-বাড়ির বউ! খবর পেতাম, বাবা কখনও খাটছেন তোমাদের বাগানে পাঁচিল তোলার। ফরমাশ, কখনও বা ‘দুরস্ত’ করছেন আমার শাশুড়িঠাকরুণ, তোমার মায়ের বিছানা। আমার মা যে ক্রমশ কোথায় হারিয়ে গেলেন, আমি অন্তত জানি না। ক্রমেই বুঝতে পারলাম ঠাকুরপো, আমি যতই চেষ্টা করি না কেন, মেজবউঠাকরুণের চোখে আমি এ-বাড়ির বাজার সরকারের মেয়ে ছাড়া আর কিছুই নই। এই পরিচয় থেকে, এই সামান্যতা থেকে আমার মুক্তির কোনও উপায় নেই। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের যোগ্য স্ত্রী হওয়া এ-জীবনে আমার পক্ষে যে সম্ভব নয়, এ কথাটা ঠাকুরবাড়ির মেয়েমহল এতদিন ধরে ক্রমাগত আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে। সারা ঠাকুরবাড়িতে আমি একটিই প্রাণের মানুষ পেয়েছিলাম রবি। সে-মানুষ তুমি! তুমি বুঝেছিলে আমার দহন। আমার সকল কষ্ট সহ্য হয়। তোমার দেওয়া কষ্ট আমি সহ্য করতে পারি না কেন তুমি লিখলে :
চেয়োনা চেয়ো না ফিরে ফিরে,
হেথায় আলো নাহি, অনন্তের পানে চাহি
আঁধারে মিলাও ধীরে ধীরে।
তোমার কথাই আমি মাথা পেতে মেনে নিলাম রবি। আমার সামনে অনন্ত আঁধার। রবিহীন নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। আমি তোমারই নির্দেশে সেই দিকে পা বাড়ালাম।
রবি, তখন তুমি বিলেতে। মনে হচ্ছে কত বছর তোমাকে দেখিনি। তোমার ফিরে আসার দিন। গুনে কাটছে আমার রাতদিন। একদিন কুটনোকোটার আসরে মেজবউঠাকরুণ বললেন—
‘নতুনের জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল। কী যে একটা বিয়ে হল ওর। কোথায় নতুন আর কোথায় তার বউ! এ বিয়েতে মনের মিল হওয়া সম্ভব নয়। স্ত্রী যদি শিক্ষাদীক্ষায় এতটাই নীচু হয়, সেই স্ত্রী। নিয়ে ঘর করা হয়তো যায়, সুখী হওয়া যায় না। নতুন তো আমার কাছেই সারাক্ষণ পড়ে থাকে। গান-বাজনা-থিয়েটার নিয়ে আছে, তাই সংসারের দুঃখটা ভুলে আছে। ‘
কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে গেলেন মেজবউঠাকরুণ। তারপর কেউ একজন ফোড়ন কাটলেন। এবার মেজবউঠাকরুণ বললেন আমাকে নিয়ে তাঁর আসল হতাশার কথা—
‘আমি তোনতুনের যোগ্য পাত্রী দেখেছিলাম। আমার স্বামীর বন্ধু ডাক্তার সূর্যকুমার চক্রবর্তীর বিলেতফেরত মেয়ে। নতুনের পছন্দও হয়েছিল। কিন্তু সে-বিয়ে হল কোথায়? নতুনের ভাগ্যে নেই, হবে কোথা থেকে!’
মেজবউঠাকরুণের এ-কথাটা ঠাকুরবাড়ির মেয়েমহলে রটে গেল হু-হু করে। ডাক্তার সূর্যকুমার চক্রবর্তীর বিলেতফেরত মেয়ের গুণাবলির কথা কতভাবে যে আমার কাছে আসতে লাগল। সেই সঙ্গে শুনতে লাগলাম আমার জন্যে ঠাকুরবাড়ির হতাশার নিশ্বাস। সত্যিই তো ঠাকুরপো, কোথায় সূর্যকুমারের বিলেতফেরত মেয়ে, আর কোথায় ঠাকুরবাড়ির বাজার সরকারের মেয়ে। আমি ক্রমশ হয়ে উঠলাম ঠাকুরবাড়ির করুণার পাত্রী।