আমি খাতাটি খুলতেই চোখে পড়ল এই দুটি লাইন :
হেথা হতে যাও পুরাতন!
হেথায় নতুন খেলা আরম্ভ হয়েছে!
পরের ঘটনা আমার কিছু মনে নেই। রবি, আমি কী করে তোমাদের ঘর থেকে আমার ঘরে এসেছিলাম, আজও মনে পড়েনি আমার। শুধু মনে আছে, যখন চেতনা ফিরল তখন রাত্তির হয়ে গেছে। আমি আমার বিছানায়। ঘর অন্ধকার।
ঠাকুরপো, কে ছিলেন আমার মা? তোমরা তাঁকে কখনও কোথাও দেখেছ? কখনও কি আমি পেয়েছি মায়ের আদর? চার কন্যার জন্ম দিয়েছিলেন আমার মা-বরদা আর মনোরমা, আমার দুই দিদি, আর শ্বেতাম্বরী, আমার ছোটবোন। আমি শ্যাম গাঙ্গুলির তিন নম্বর মেয়ে—শুধু বাবার নামেই আমার পরিচয়। কোথায় হারিয়ে গেলেন আমার মা? তাঁকে আমার মনেই পড়ে না। তোমার নতুনদাদাকে আমার মায়ের কথা কোনওদিন জিগ্যেস করতে সাহস হয়নি।
আমার বাবা, তাঁর সব অপমান সত্বেও এক অর্থে তো ঠাকুরবাড়িরই ছেলে। তাই এ-বাড়িতেই আমার জন্মের আগে তাঁর স্থান হয়েছিল। তাঁর বাসা ছিল জোড়াসাঁকোর বিরাট বাড়িটার নীচের তলায়, পায়রার খোপের মতো একটি ঘরে। আমার জন্ম কোথায় ঠাকুরপো? হাড়কাটা গলিতে? কি তোমাদের বাড়ির নীচের তলায়, যেখানে তোমরা আশ্রয় দিয়েছিলে গরিব আত্মীয়স্বজনদের?
ঠাকুরপো, আমি তোমাকে দেখতাম দূর থেকে। তুমি নামতে নানীচের তলায়। কোনওদিন আসনি আমাদের বাড়ি। কেনই বা আসবে। কত বড় ধনী পরিবারের ছেলে তুমি। তুমি তখন। বছর ছয়টয় হবে। আমি আট। তোমাকে দেখতাম দুর থেকে। দক্ষিণের বারান্দায় রেলিং ধরে তুমি দাঁড়িয়ে থাকতে। তোমার দৃষ্টি থাকত আকাশ পানে। মাঝে-মাঝে তুমি খেলা করতে। বাগানে। ইচ্ছে করত তোমার সঙ্গে গিয়ে খেলা করি।
একদিন তখন তুমি আমার খুব বন্ধু, সেই যখন নন্দনকানন করছি দু’জনে মিলে, তুমি বিলেত থেকে ফেরার পরেই, তখন তোমাকে জিগ্যেস করেছিলাম, ঠাকুরপো, আমাকে মনে পড়ে। তোমার, কেমন ছিলাম আমি এ-বাড়ির বউ হওয়ার আগে, তোমাদের নীচের তলায়?
কথাটা শুনেই কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে গেলে তুমি। কুঁকড়ে গেলে ভিতর থেকে। শুধু বললে, ‘মনে তো পড়ে না কিছু।’
আমি বললাম, ‘কিছু মনে পড়ে না? আমি নীচের তলা থেকে দেখতাম তোমাকে, তুমি যখন এসে দাঁড়াতে দক্ষিণের বারান্দায়। একদিন তোমাকে দেখে হাত নেড়েছিলাম। মনে পড়ে তোমার?
তুমি বললে, ‘নীচের দিকে দেখতামই না আমি। আমি তো আকাশ দেখতাম। তোমার আকাশ দেখতে ভালো লাগত না?’ আমি বললাম, ‘আমার ঘর থেকে আকাশ দেখা যেত না। আমার তো তোমার মতো বারান্দা ছিল না ঠাকুরপো। ‘
হয়তো আমার কথা শুনে খুব কষ্ট হয়েছিল তোমার। কোনও কথা বললে না। নন্দনকাননের চাঁপা গাছ থেকে একটা স্বর্ণচাঁপা তুলে হঠাৎ গুঁজে দিলে আমার খোঁপায়।
প্রাণের ঠাকুরপো, যে-অবস্থার মধ্যে কেটেছিল আমার শৈশব সেখানে কোনওদিন পৌঁছয়নি তোমাদের বড় বাড়ির কোনও রোশনাই। হাসি, গান, আনন্দ। ঠাকুরবাড়ির ফরমাশ খাটা বাজার সরকারের কালো রোগা মেয়েটার জীবনের সঙ্গে তোমার জীবনের কোনও মিল ছিল না, তোমার নতুনদাদার সঙ্গে আমার বিয়ের আগে।
হঠাৎ ঠাকুরবাড়ির বউ হয়ে এসে পড়েছিলাম তোমাদের অন্দরমহলে। এসে দেখলাম কী এলাহি ব্যাপার! ছেলেমেয়ে জামাই-বউ, নাতি-নাতনি, দাসদাসীতে বাড়িটা গমগম করছে। কে কার কী, কার সঙ্গে কার কী সম্পর্ক, এ বুঝে উঠতে আমার বেশ সময় লেগেছিল। একটা কথা বুঝতে অসুবিধে হয়নি–ঠাকুরবাড়িতে প্রতিদিনই যেন উৎসব। বাড়ির রান্নাঘরে দশ-বারোজন। বামুনঠাকুর ভোর থেকে রান্না চড়ায় গনগনে উনুনে। রান্নার ব্যবস্থাও দু-রকমের। একটা ‘সরকারি’। একটা ‘বেসরকারি’। ঘরে-ঘরে যে-রান্না বামুনঠাকুরেরা পৌঁছে দেয়, সেটা ‘সরকারি’। রান্না। কিন্তু প্রতি মহলে ঘরে-ঘরে তো লোক! প্রত্যেকের রুচি আলাদা। সুতরাং প্রতি মহলের। জন্যে তোলা উনুনে স্বামী ও স্ত্রীদের ফরমাশ অনুসারে কিছু বিশেষ রান্নাও হয়। সেটা। ’বেসরকারি’ রান্না। এসব দেখে আমি তো তাজ্জব। তোমার নতুন দাদার খাওয়ার রুচি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমার ওপর ভার পড়ল তাঁর রুচি অনুসারে রান্না করার। রান্নার তখন আমি কিছুই জানতাম না। ধীরে ধীরে শিখতে হল সবই। আমার একেবারেই ভালো লাগেনি ঠাকুরবাড়ির ভাঁড়ার ঘরে বৈঠকি আড্ডা। তরকারি কোটার আসরে সবাইকে থাকতে হত। আমিও থাকতাম। আমার মন পড়ে থাকত তোমার কাছে ঠাকুরপো। সেই ভাঁড়ার ঘরের আড্ডাতেই ঠাকুরবাড়ির। মহিলামহলের কত খোঁটা কত গঞ্জনা যে আমাকে সহ্য করতে হয়েছে। প্রথম প্রথম আমার সন্তান হল না বলে গঞ্জনা—আমি বাঁজা, এই বাঁজা বউকে বিয়ে করে তোমার নতুন দাদার কত হতাশা, কত যন্ত্রণা, এসব কথা যে কতভাবে আমি শুনেছি। তারপর এল তোমার-আমার সম্পর্ক নিয়ে। গুঞ্জন—তোমাকে সাহস করে যে-কথা কেউ বলতে পারতেন না, বলতেন আমাকে। আমিই নাকি তোমাকে নষ্ট করছি, তোমার মাথা খাচ্ছি!
প্রাণের ঠাকুরপো, দেখলে তো গুছিয়ে লেখা আমার পক্ষে সম্ভবই নয়, বিশেষ করে মনের এই অবস্থায়। যত বেলা বাড়ছে, ততই যে এগিয়ে আসছে আমার চিরবিদায়ের মুহূর্ত, আরও বিপন্ন, বিষণ্ণ হয়ে পড়ছে মন, দিশেহারা হয়ে যেকথা বলতে চাই, তার থেকে দূরে চলে যাচ্ছি বারবার। আমার তো আর বেশি সময় নেই। অথচ সব কথা যে বলতেই হবে তোমাকে হে আমার। প্রিয়তম পুরুষ, প্রিয়তম বন্ধু, আমার চিরসখা, তোমাকে না বলে যে আমি মরতে পারব না।