বৃষ্টিতে ভিজছ তুমি। কী সুন্দর দীর্ঘ শরীর তোমার। তোমার দীর্ঘ সিক্ত কেশদাম নেমে এসেছে বলিষ্ঠ গ্রীবা পর্যন্ত। তোমার আয়ত দুটি চোখে মেঘলা আকাশের মায়া। তুমি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলে :
‘ঠাকুরবাড়িতে একটি উপবাসে আমরা সবাই কষ্ট পেয়েছি। চিরকাল, আদরের উপবাস। ‘
‘আদরের উপবাস’—মাত্র দুটি শব্দ, অথচ আমার সমস্ত শরীরের মধ্যে বৃষ্টির জলের সঙ্গে মিশে বয়ে গেল ওই শব্দ দুটি—তোমার কণ্ঠস্বর স্পর্শ করল আমার সমস্ত শরীর। আমি স্থানকাল ভুলে গেলাম। মনে হল প্রবল বৃষ্টির মধ্যে তোমার শরীর গলে যাচ্ছে আমার শরীরের মধ্যে। মনে হল আমার শরীর মিশে যাচ্ছে তোমার শরীরে। কোনও তফাত নেই আর।
তোমার দিকে মুখ তুলে বললাম, ‘আমাকে একটু আদর করবে ঠাকুরপো?–কতদিন কতদিন কোনও আদর পাইনি আমি। ‘
তুমি যেন জলদেবতা। সামান্য নীচু হলে তুমি। আমার মুখখানি তুলে নিলে কত আদরে—চুমু খেলে আমার ঠোঁটে। এক ঝলকের আলতো চুমু। মনে হল, এই প্রথম আদর পেলাম আমি। হতে পারে অন্যায়। তবু মনে হল, জীবনে এরচেয়ে বেশি কিছু, বড় কিছু, পবিত্র কিছু আমি পাইনি। যেন এতকাল বেঁচে ছিলাম এই মুহূর্তটির জন্যেই। আমার ঠোঁটে তোমার সেই প্রথম চুমু আজও ফুরিয়ে যায়নি ঠাকুরপো। আমার জীবন ফুরিয়ে যেতে চলল।
আবার খেই হারিয়ে ফেলেছি। তোমার মতো গুছিয়ে যদি লিখতে পারতাম। অথচ না লিখেও উপায় নেই। অনেক কথা যে বলার আছে তোমাকে। পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার আগে আমি তোমাকে সব সব সব কথা বলে যেতে চাই—উজাড় করে। যদি একবার কাছে পেতাম তোমাকে খুব আদর করতাম। তখন আর এত কথা বলতাম না হয়তো।
কিন্তু তোমাকে আজকাল শুধু দূর থেকে দেখি। গত চারমাস তোমার বিয়ে হয়েছে। গত চারমাসে ঠাকুরপো, কতদূরে সরে গেছ তুমি? কী করে পারলে গো!
তুমি কি জানো ঠাকুরপো, নন্দনকাননের সব গাছ মরে গেছে এই ক’মাসে। জল না পেয়ে, যত্ন পেয়ে, আদর না পেয়ে মরে গেল তারা। আমাদের সাধের নন্দনকানন আদরের উপবাসে মরল ঠাকুরপো।
ঠাকুরপো, গত চারমাস তুমি তোমার নতুন বউকে নিয়ে ব্যস্ত। তোমার নতুনবউঠান এখন পুরাতন। আজকাল তুমিও তোমার জ্যোতিদাদার মতো বাড়ি ফের না। মাঝেমধ্যেই রাত কাটাও মেজবউঠাকরুণের বাড়িতেই। সেখানে যে চলছে তোমার বালিকাবধূর মাঝাঘষা, মেজবউঠাকরুণের নিজের হাতে। তোমার বন্ধ ঘরের দিকে তাকিয়ে কত বিকেল-সন্ধে-রাত কেটে যায় আমার। সব থেকে অসহ্য একলা আমার দুপুরবেলা। তোমার পায়ের শব্দ শুনতে পাই সারাক্ষণ। মনে হয়, এই বুঝি এলে তুমি, ‘নতুন বউঠান, চলে এলাম তোমার কাছে’, এ-কথা বলে আমার পাশে শুয়ে পড়লে।
ক’দিন আগে আর পারলাম না। ঢুকে পড়লাম তোমার ঘরে। ঢুকে দেখলাম পাথরের টেবিলে তোমার কবিতার খাতাটি উপুড় করে রেখে গেছ তুমি। যেন কোনও কবিতা লিখতে লিখতে উঠে গেছ।
বুকের ভিতরটা টনটন করে উঠল। তোমার বিয়ের পরে এ ক’মাস আর একটি কবিতা পড়ে শোনাওনি আমাকে। ঠাকুরপো, তুমি তো বলেছিলে, আমার জন্যেই তুমি লেখো তোমার সব লেখা—তোমার লেখার মধ্যে লুকোনো থাকে অন্য লেখা, যা শুধু আমি পড়ব, আমি বুঝব—সে লেখা আর কারও জন্যে নয়। কেন মিথ্যে বলেছিলে ঠাকুরপো? এই ছলনার কি কোনও প্রয়োজন ছিল? প্রাণের রবি, আমি তোমাকে কখনও কোনও মিথ্যে বলিনি। আমার মধ্যে কোনও ছলনার আশ্রয় নেই। আমি পেয়েছি তোমার ভালোবাসা। ঠাকুরপো, আর কোনও মেয়ে এভাবে তোমার ভালোবাসা কখনও পাবে না হয়তো। আমার জীবন সার্থক। সেই ভালোবাসা হারিয়ে আমার বেঁচে থাকার কোনও অর্থ হয় না।
ঠাকুরপো, বলতে লজ্জা করছে—তবু, না বলেও পারছিনা। আমি কখনও-কখনও লুকিয়ে-চুরিয়ে তোমার কবিতার খাতা পড়ি। আর তখন খুব কান্না পায় আমার। সবে বিয়ে করেছ তুমি। খুব। স্বাভাবিক তোমার কবিতায় এখন অত আদর, এত শরীর ছড়িয়ে থাকবে। তবু…আমার খুব কান্না পায়, কষ্ট হয়, বুকের শিরায় টান ধরে, মনে হয় আমার অপমান এতদিনে সম্পূর্ণ হল।
তোমার একটি কবিতার নাম ‘স্তন’। চমকে উঠলাম নাম দেখে। এ তো তোমারই হাতের লেখা। ’স্তন’ শব্দটি ফুলের মতো ফুটে আছে তোমার অনিন্দ্যসুন্দর হস্তাক্ষরে। তুমি লিখেছ :
সহসা আলোতে এসে গেছে যেন থেমে—
শরমে মরিতে চায় অঞ্চল-আড়ালে।
এই লাইন দুটি আমার গলা চেপে ধরল। আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। একটি প্রশ্ন অসুখের মতন ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত শরীরে কোথাও কি ভাবনি তুমি আমার কথাও? একবারও না? আর একটি কবিতায় চোখ গেল আমার। কবিতার নাম ‘চুম্বন’। তুমি লিখেছ :
দুইটি তরঙ্গ উঠি প্রেমের নিয়মে
ভাঙিয়া মিলিয়া যায় দুইটি অধরে।
প্রেম লিখিতেছে গান কোমল আদরে
অধরেতে থরে থরে চুম্বনের লেখা।
ঠাকুরপো, সত্যি কথা বলো, তোমার কি একবারও মনে পড়েনি নন্দনকাননে সেই বৃষ্টির আড়াল, সেই আদর, সেই নিবিড় আলিঙ্গন আর চুম্বন? এই লাইনগুলোর মধ্যে কি তোমার-আমার আদর এতটুকুও নেই ঠাকুরপো? বলো-বলো-বলো।
প্রাণের রবি, পাথরের টেবিলে তোমার খাতাটি উপুড় করা আছে দেখে মনে হল, না থাক, আবার তোমার লেখা পড়ে যদি কষ্ট পাই আমি। যদি আবার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে বুকের শিরা ছিড়ে যায়। কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা আমার আর নেই রবি। পরক্ষণেই মনে হল, হয়তো এমনকিছু লিখেছ যা আমার মন ভালো করে দেবে, যে-লেখার মধ্যে লুকোনো আছে অন্য লেখা, যে-লেখা শুধু তুমি আমি পড়ব, সেই লেখা আর কেউ বুঝবে না।