ঠাকুরপো, আমার একটি দুঃখের জায়গা—আমার চোখের সামনে আমার বাবার অপমান–দিনের পর দিন। আমি ঢুকলাম তোমাদের বাড়ির অন্দরমহলে—কিন্তু বাবা থেকে গেলেন বারমহলে, সামান্য বেতনের শ্যাম গাঙ্গুলি হয়ে। যদিও তিনি ঠাকুরবাড়ির বেয়াই, কোনও সম্মান পাননি কোনওদিন। সেই উদারতা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে ছিল না ঠাকুরপো। ছিল শুধু তোমার মধ্যে–কিন্তু তুমি তো আলাদা, সবার থেকে অন্যরকম।
আমার বাবা যে সারা জীবন ঠাকুরবাড়ির অসম্মানের মধ্যেই থাকতে বাধ্য হলেন, তার কারণ, তোমাদের দাক্ষিণ্যেই আমাদের পরিবার চিরকাল খেতে পরতে পেয়েছে। তোমাদের দাক্ষিণ্যেই। তো আমি ঠাকুরবাড়ির বউ হতে পেরেছিলাম।
কিন্তু তবু ডালে-ডালে পাতায়-পাতায় আমিও তো দ্বারকানাথের পরিবারের সঙ্গে জড়িত। তোমার ঠাকুরদা দ্বারকানাথের মামাতো বোন শিরোমণিকেই তো বিয়ে করেন আমার ঠাকুরদা। জগন্মোহন। দ্বারকানাথের মামা অথাৎ শিরোমণির বাবার নাম ছিল কেনারাম রায়চৌধুরী। আমার অসন্মানটা কোথায় জানো ঠাকুরপো? হাড়কাটা গলির বাড়িটা কিন্তু শিরোমণি তাঁর বাবার কাছ থেকে পাননি। পেয়েছিলেন কাকিমা রামপ্রিয়ার কাছ থেকে।
কে এই রামপ্রিয়া? তুমি হয়তো জানো না, আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, রামপ্রিয়া ছিলেন। দ্বারকানাথের ঠাকুরদা নীলমণি ঠাকুরের ভাই গোবিন্দরামের স্ত্রী। রামপ্রিয়া কেন কুখ্যাত বণিতাপাড়া হাড়কাটা গলিতে একখানি বাড়ি দিতে গেলেন শিরোমণিকে? বারে, আমার ঠাকুরদা জগন্মোহন, যাকে তোমাদের বাড়ির সবাই জগমোহন বলে ডাকেন, তিনি তো গরিব মানুষ–বিয়ের পরে বউকে নিয়ে থাকবেন কোথায়? তাই খারাপপাড়ার একখানা গেরস্তবাড়ি দেওয়া হল তাঁর বউকে–দিলেন বউয়ের কাকিমা রামপ্রিয়া। আমার ঠাকুরদা আর ঠাকুমা ওই হাড়কাটা গলিতেই থাকতেন। এমন একটা মানুষকে ঠাকুরবাড়ির আভিজাত্য কী চোখে দেখবে তা তো তোমাকে বলে বোঝাতে হবে না ঠাকুরপো।
আমার বাবা শ্যাম গাঙ্গুলির কাজ জুটল তোমাদের বাড়িতেই। বাজারসরকারে কাজ। আর নানারকম ফরমাশ খাটার কাজ। আমার বিয়ের পরেও সেকাজ তাঁকে করতে হয়েছে— বারবাড়ির ফরমাশই তিনি বেশি খাটতেন। অন্দরমহলে তাঁকে কদাচিৎ দেখতে পেতাম। স্বয়ং জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী আমি—অথচ জ্যোতিরিন্দ্রিনাথ তাঁর জামাই, তিনি এবাড়ির বেয়াই, এসব কথা তাঁর পক্ষে স্বপ্নেও ভাবা সম্ভব হয়নি।
হঠাৎ ঠাকুরবাড়ির আভিজাত্যের টনক নড়ল। কেউ-কেউ ভাবতে শুরু করলেন, শ্যাম গাঙ্গুলিকে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে না রাখাই ভালো—দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিলে সামাজিক লজ্জা থেকে দু পক্ষেরই মুক্তি। সামান্য বেতনে আমার বাবাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল তোমাদের গাজিপুরের। বাড়িতে। সেখানে তোমাদের বিশাল জমিদারি। অনেক বড় বাড়ি। দায়িত্বও অনেক। আমার বাবা আমার চোখের সামনে থেকে সরে গেলেন। আমি বাঁচলাম। এও তো ঠাকুরবাড়িরই দান। আমি কৃতজ্ঞ।
ঠাকুরপো, সবে তখন বিয়ে হয়েছে আমার। ন’বছরের বালিকা আমি। একদিন মেজবউঠাকরুণের ঘরের পাশে যেতেই শুনতে পেলাম মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কণ্ঠস্বর। তিনি তাঁর স্ত্রীকে বলছেন—
‘এ কাকে নিয়ে এলে বাড়িতে? ওই মেয়েটা জ্যোতির যোগ্য পাত্রী! কোনদিক থেকে সে জ্যোতির মতো ছেলের উপযুক্ত? এটা একটা বিয়ে হল?’
ঠাকুরপো, আমার খুব ভয় করল কথাটা শুনে। আর খুব দুঃখও হল। ভয় করল, যদি আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় সবাই মিলে? আমি কোথায় যাব?
মেজবউঠাকরুণ বললেন, ‘ওকে আমরা মেজেঘষে তৈরি করে নেব। তাছাড়া, জ্যোতি ঠাকুরপোরও কিছুটা দায়িত্ব আছে ওকে নিজের মনের মতো করে গড়ে তোলার। ‘
মেজবউঠাকরুণের কথায় যেন আগুনে ঘি পড়ল। জ্বলে উঠলেন সত্যেন্দ্রনাথ। বললেন, ‘ও মেয়ে কোনওদিন ভালো মেয়ে হবে না, তোমরা দেখে নিও। বাজার সরকার শ্যামের মেয়ে হয়ে উঠবে জ্যোতির যোগ্য স্ত্রী? তোমরা মেজেঘষে কাকে তৈরি করবে? জ্যোতির এ বিয়েতে আপত্তি করা উচিত ছিল। ‘
আমার হাত-পা সব কাঁপতে লাগল। খুব কান্না এল বুকের মধ্যে। কিন্তু চোখ শুকনো। মেজবউঠাকরুণকে বলতে শুনলাম, ‘বাবামশায়ের ইচ্ছে এ-বিয়ে হোক। জ্যোতি ঠাকুরপো বাবামশায়ের বিরুদ্ধে কথা বলবে, এ-কথা তুমি ভাবতে পারলে!’
‘এটা বাবামশায়ের জেদ। অন্যায় জেদ। জ্যোতি মেনে নিল বটে, কোনও প্রতিবাদ পর্যন্ত করল না—এ বিয়েতে কারও মঙ্গল হবে না। ‘
ঠাকুরপো, ওই কথাটা আজও আমার কানে লেগে আছে—’এ বিয়েতে কারও মঙ্গল হবে না। ‘ তোমাদের সংসারে সবথেকে বড় অমঙ্গল আমি। তোমাকে ভালোবেসে আমি অসতীও। আজ সেই অমঙ্গলের, অসতীর বিদায়। আমি চাই তোমাদের সংসারে সুখ-শান্তি ফিরে আসুক। তোমার নতুন দাদা আমাকে স্ত্রী হিসেবে পেয়ে মনে হয় না একদিনের জন্যেও সুখী হয়েছিলেন। মনেরই তো মিল হল না আমাদের। সত্যিই আমি ওঁর যোগ্য স্ত্রী হতে পারলাম না। উনি সারাজীবন থেকে গেলেন অনেক দূরের মানুষ। ঠাকুরপো, তুমি আমাকে এত ভালোবাসলে। ভালোবাসলেন কবি। বিহারীলাল চক্রবর্তী। আমার প্রতি বিহারীলালের ভক্তি, অনুরাগ—সত্যিই আমাকে লজ্জা দিত।
কিন্তু তোমার নতুনদাদার প্রেম–না, পেলাম না কোনওদিন। কোনওদিন তাঁর কাছের মানুষ হয়ে ওঠার সম্মানটুকুও পাইনি। ঠাকুরপো, তোমার কাছে লুকোবার কিছু নেই। তুমি অন্তত অনুভব। করতে পেরেছ, আমার সঙ্গে তোমার নতুনদাদার সম্পর্কটা বড় বেশি সাজানো। আমাদের সম্পর্কে কোনও প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়নি ঠাকুরপো। সম্পর্কের ভেতরটা একেবারে শীতল। ঠাকুরপো, আমার মনে আছে, একদিন ঘোর বৃষ্টির মধ্যে তুমি আমি দু’জনেই ভিজছি আমাদের বড় সখের নন্দনকাননে। এদিকটা শুধুই আমাদের। এদিকে কেউ বড় একটা আসতেন না। বৃষ্টির মধ্যে। মালতীলতার আড়ালে তুমি হঠাৎ আমাকে বুকের মধ্যে টেনে নিলে। সেই টানের মধ্যে তোমার অন্তরের উজান ছিল ঠাকুরপো। আমি বাধা দিতে পারিনি। চাইওনি। কোনও-কোনও অন্যায়ের গলায় দুলে ওঠে হৃদয়ের বরমাল্য। সেই অন্যায়কে বরণ করে নেয় সমস্ত মন প্রাণ। ঠাকুরপো, তোমার আলিঙ্গন ছিল তেমন অন্যায়।