ঠাকুরপো, কথায়-কথায় খেই হারিয়ে কোথায় চলে এলাম! তোমাকে তো বলেইছি, মনটা বড় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারছি না। বলতে যাচ্ছিলাম আমার জন্মের আগের কথা। সেকথা বলতে গিয়ে কোথায় চলে এলাম। ঠাকুরবাড়িতে, বিশেষ করে এ বাড়ির মেয়েমহলে, আমার সে অপমান, তার সূত্র ধরে চলে যাওয়া যায় আমার জন্মের আগের ঘটনায়–আমার ভাগ্য সেইসব ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
প্রাণের রবি, ঠাকুরবাড়ির বউ হওয়ার আগে তোমাদের কাছে—না না তোমার কাছে নয়, তুমি তো আমার ভালোবাসার মানুষ—আর সকলের কাছে বিশেষ করে তোমার আইসিএস
সেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর আর তাঁর বিলেতফেরত স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনীর কাছে আমার পরিচয় ছিল, আমি তোমাদের বাজারসরকার শ্যাম গাঙ্গুলির তিন নম্বর মেয়ে। সেটাই অবিশ্যি আমার সম্পর্কে শেষ কথা নয়। আরও একটু আছে—এমন এক পরিবারে জন্ম আমার যে-পরিবারের থাকা-খাওয়া জোটে তোমাদের, অর্থাৎ ঠাকুরবাড়ির দাক্ষিণ্যে।
আমার ঠাকুরদা জগন্মোহন গঙ্গোপাধ্যায় এক গুণী সঙ্গীতশিল্পী। সে কথা তুমি তো জানো ঠাকুরপো। কতবার তুমি আমাকে বলেছ, আমি আমার গানের গলা পেয়েছি আমার ঠাকুরদার। কাছ থেকে। কিন্তু তাঁর গুণের কোনও স্বীকৃতি ছিল না অভিজাত, ধনী ঠাকুরবাড়িতে তিনি যে গরিব, তোমাদের দাক্ষিণ্যে বেঁচে আছেন।
তোমরাই তাঁকে মাথা গোঁজার জন্যে একটা বাড়ি দিয়েছিলে—কলকাতার খারাপ পাড়া হাড়কাটা গলিতে। আমি হয়তো সেই হাড়কাটা গলির মেয়ে। তাই জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির মহিলামহল আমাকে সারাজীবন এত হেয় করল, কষ্ট দিল।
হাড়কাটা গলির ওই বাড়িটা আমার ঠাকুরদা পেয়েছিলেন দান হিসেবে। কিন্তু সে ছিল করুণার দান। সেই দান গ্রহণ করার মধ্যে কোনও সম্মান ছিল না।
ঠাকুরপো, আমি জানি না ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে আমার বাড়ির সম্পর্ক তুমি কতটা জানো। জানলেও, আমাকে জানতে দাওনি যে তুমি জানো। এক অর্থে আমিও কিন্তু ঠাকুরবাড়ির মেয়ে। কিন্তু সেকথা ভাববার অধিকার আমাকে কেউ কোনওদিন দেননি। আমি ঘাটেরও নই, পারেরও নই। এইভাবে কেটে গেল আমার জীবনের পঁচিশটা বছর।
আমার পরিবারের গল্প, আমার জন্মের কাহিনি আজ তোমাকে কিছুটা বলে যাই। তা হলে হয়তো কিছুটা বুঝবে, কী আমাকে দহন করেছে এত বছর ধরে। আমার মৃত্যু কী জুড়াবে!
আমার ঠাকুরদা জগন্মোহনের সঙ্গে বিয়ে হয় তোমার ঠাকুরদা দ্বারকানাথের মামাতো বোন শিরোমণির। এসব কথা তোমাকে দু-একদিন বলবার চেষ্টা করেছিলাম। তুমি বলতে, থাক না সেই সব দূরের কথা, কিছুতেই বলতে দিতে না তুমি, পাছে এসব কথা বলতে গিয়ে আমি ভিতরে-ভিতরে কষ্ট পাই।
একদিন বললে—আমার বেশ মনে আছে, দুপুরবেলা আমার শোবার ঘরের খাটে আমার পাশেই শুয়েছিলে তুমি—চুপচাপ ছিলে অনেকক্ষণ, জানলা দিয়ে দেখছিলে আকাশে মেঘের ঘনঘটা— আমি সেই সুযোগে তোমাকে শোনাতে চাইলাম আমার পরিবারের পূর্বকথা—তুমি বললে, ‘নতুন বউঠান, কী হবে পুরোনো দুঃখ-কষ্টের কথা ভেবে ভুবন জুড়ে এত আনন্দ, সেই আনন্দধারাকে অন্তরে গ্রহণ করো, দেখবে ঝরা পাতার মতো পুরোনো দুঃখ সেই আনন্দস্রোতে ভেসে গিয়েছে। ‘
আমি তোমার হাতটি এনে রাখলাম আমার বুকের ওপর। বললাম, ‘শত দুঃখের মধ্যেও সেই আনন্দকে আমি ধরে আছি এই মুহূর্তে আমার বুকের মাঝখানটিতে। ‘
ঠাকুরপো, আমার মনে হল যেন চিরকাল তোমার হাতটিকে আমার বুকের মাঝখানটিতে এইভাবে ধরে রাখতে পারি—তুমি আর কারও নও ঠাকুরপো, শুধুই আমার।
আজ পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার আগে বুকের মাঝখানটা বড্ড খালি হয়ে গেছে। কিছু নেই। সেখানে। শুধু শূন্য। কোথায় তোমার হাত? কোথায় তোমার সেই সুধাময় স্পর্শ ঠাকুরপো? সব হারিয়ে গেল? সব তুমি কেড়ে নিলে?
তুমি হঠাৎ বললে, ‘চলোতো নাটকের মহড়াটা আরও একবার শুরু করা যাক। তোমার মন এখুনি ভালো হয়ে যাবে বউঠান। ‘ তখন তোমার জ্যোতিদার লেখা ‘অলীকবাবু’ নাটকের মহড়া চলছে। রোজ বিকেল থেকে সন্ধে পর্যন্ত। সেই নাটকের নায়ক-নায়িকা তুমি আর আমি। নায়ক অলীকবাবু তুমি, নায়িকা হেমাঙ্গিনী আমি। যার পর থেকে তুমি আমাকে চুপিচুপি ‘হে’ বলে ডাকতে শুরু করলে।
আমি তোমার হাতখানি বুকের মাঝে ধরে সেই দুপুরবেলা আমার খাটে শুয়ে-শুয়ে শুরু করলাম নাটকের মহড়া :
‘আমি জগতের সমক্ষে, চন্দ্রসূর্যকে সাক্ষী করিয়া, মুক্তকণ্ঠে বলিব, লক্ষবার বলিব, তুমিই আমার স্বামী, শতবার বলিব, সহস্রবার বলিব, লক্ষবার বলিব, আমিই তোমার স্ত্রী। ‘
তুমি চুপ করে শুনলে, কোনও কথা বললে না অনেকক্ষণ। তোমার হাতটিকে আমার বুকের ওপর থেকে সরিয়ে নিলে না। পাশ ফিরে শুধু তাকালে আমার মুখের দিকে।
ঠাকুরপো, আজও ভুলতে পারিনি তোমার সেই আর্তিময় আঁখিপাতের মায়া।
০৩. আবার এলোমেলা চলতে-চলতে
আবার এলোমেলা চলতে-চলতে যে-কথা বলতে যাচ্ছিলাম, তার থেকে কতদূরে চলে এলাম! এই রকমই ঘটতে থাকবে ঠাকুরপো। মৃত্যুর এত কাছে দাঁড়িয়ে কখনও তো কিছু লিখিনি—যেই সে-কথা ভাবছি অবশ হয়ে আসছে দেহ-মন। মনের মধ্যে সব কিছু অগোছালো, শিথিল হয়ে। যাচ্ছে। তোমাকে যে এ-চিঠি পড়তেই হবে, তাও নয়। চিঠিটা আমার সঙ্গে চিতায় জ্বালিয়ে দিও।