ঠাকুরপো, কঠিনতম আদেশটি তোলা ছিল আমার জন্যে। তোমার কনের দেখার দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর! আর সঙ্গে থাকবে তুমি! বাবামশাই স্বয়ং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই মৃত্যুদন্ড কী। অনায়াসে আমাকে দিয়েছিলেন! আমার মৃত্যু ঘটেছিল যশোরেই।
দক্ষিণডিহি, চেঙ্গুটিয়া কত জায়গা থেকে যে কত মেয়ের খবর আসত। দৌড়ে যেতাম। সঙ্গে কখনও-কখনও তুমিও থাকতে। তোমার অমন ভাবলেশহীন মুখ আমি কখনও দেখিনি ঠাকুরপো। তোমার ভাবটা ছিল এমন, যে মেয়েকে আমি পছন্দ করব, তুমি বিয়ে করতে প্রস্তুত তাকেই। তোমার মুখে পছন্দ-অপছন্দের কোনও আভাস পেতাম না আমি। অনেক মেয়ে দেখা হল। আমার তো কাউকেই পছন্দ হল না। ভাবলাম, গেল বুঝি বেশ কিছুদিনের জন্য তোমার বিয়েটা পিছিয়ে। হঠাৎ বুকের উপর থেকে যেন একটা ভারী পাথর গেল নেমে। ভেতরে-ভেতরে কী যে পুলক জাগল ঠাকুরপো, তোমাকে বোঝাতে পারব না। তোমাকে বলেছিলাম, ঠাকুরপো, এবছর যশোরে সুন্দরী মেয়ের আকাল পড়েছে। কী আর করবে বল? মন খারাপ কোরো না। বিয়েটা তোমার এ-বছর হচ্ছে না বলেই মনে হচ্ছে। আমার সেই খুশিখুশি কথাগুলো কি মনে আছে তোমার?
বিনা মেঘে আকস্মিক বজ্রাঘাৎ ঘটালেন মেজবউঠাকরুণ। তিনি বললেন, রবির বিয়ে এবছর হবেই। কাউকে না পেলে আমাদের কাছারির কর্মচারী বেনী রায়ের মেয়ে ভবতারিনীর সঙ্গেই রবির বিয়ে দিয়ে দেব। যশোরের ফুলতুলি গ্রামের মেয়ে ভবতারিনী। মেজবউঠাকরুণ বললেন, হাতের কাছে যশোরের মেয়ে থাকতে কেন খুঁজে মরছি চারধারে। ঠাকুরবাড়ির বউয়েরা অধিকাংশই তো যশোরের মেয়ে—ও মেয়ে ভালো মেয়ে হবেই। কথাটা বলেই মেজবউঠাকরুণ তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে। তাঁর সেই চাউনি জীবনের এই শেষ দিনেও ভুলতে পারিনি ঠাকুরপো।
বুকের ওপর আবার সেই ভারী পাথরটা ফিরে এল। নিশ্বাস যেন আটকে গেল। এক ছুঁয়ে আমার সেই খুশিভাব নিবে গেল। মনে হল আর কোনও পালাবার পথ নেই আমার। সেই মুহূর্তে অমোঘ নিয়তি ঠেলে দিল আমাকে মৃত্যুর দিকে। পঁচিশ বছর বয়েসে মরতে ইচ্ছে করছে না ঠাকুরপো। কিন্তু বাঁচব কেন? কীসের জন্যে? কাকে ভালোবেসে?
বেনী রায়ের ন’বছরের মেয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ের ঠিক হতেই আমি দীর্ঘ দিনের জন্যে অসুস্থ হয়ে পড়লাম। ভগবৎ ডাক্তারের হাতে পড়ল আমার চিকিৎসার ভার। ডাক্তার ভাবল গোলমাল বুঝি সবটাই আমার শরীরের। কেন আমার শ্বাসকষ্ট। কেন আমার ক্রমশ রোগা আর দুর্বল হয়ে। যাওয়া। কেন আমার খেতে ইচ্ছে করে না, কেন সব সময় বিষণ্ণতায় ভুগছি আমি। এই অসুস্থতার আসল কারণটা কোনও দিন ঠাওর করতে পারেননি ভগবৎ ডাক্তার। খালি ওষুধের পর ওষুধ। লিখেছেন। কেউ জানতেও পারেনি, আমি সে সব ওষুধ নর্দমায় ঢেলে দিয়েছি।
আবার চোখের সামনে চলতে লাগল তোমার বিয়ের আয়োজন। ঠাকুরবাড়ির আর সব মেয়ে বউয়ের সঙ্গে আমাকেও মিলতে হল তোমার বিয়ের আয়োজনে। তোমার বউয়ের শাড়ি-গয়না পছন্দের সময়েও আমাকে ডাকলেন মেজবউঠাকরুণ। আমি মরতে-মরতে সব দায়িত্ব পালন করতে লাগলাম।
এরপর একদিন বিকেলবেলা তুমি এলে আমার ঘরে। যেমন এক সময়ে আসতে রোজ। আমাকে পড়ে শোনাতে তোমার নতুন কবিতা, গেয়ে শোনাতে তোমার নতুন গান। সেদিন বিকেলে। একখানি চিঠি দিলে আমার হাতে। খুলে দেখি এক অভিনব নেমন্তন্নের চিঠি—তুমি নিজেই লিখেছ—
‘আগামী রবিবার ২৪শে অগ্রহায়ণ তারিখে শুভদিনে শুভলগ্নে আমার পরমাত্মীয় শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুভবিবাহ হইবেক। আপনি তদুপলক্ষে বৈকালে উক্ত দিবসে ৬নং জোড়াসাঁকোস্থ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভবনে উপস্থিত থাকিয়া বিবাহাদি সন্দর্শন করিয়া আমাকে ও আত্মীয়বর্গকে বাধিত করিবেন।
ইতি, অনুগত শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘
চিঠিটা প্রথমবার পড়ার পর আমার মাথা ঘুরতে লাগল। আমি খাটের ওপর বসে পড়লাম। তারপর চোখে জল এল। দ্বিতীয়বার পড়ার পর কিছুতেই কান্না সামলাতে পারিনি। সেই কান্না গভীর দুঃখের, তবু সেই কান্নাতে কোথায় যেন একটু ক্লান্ত আনন্দও মিশে গেল। বললাম, ঠাকুরপো, নিজের বিয়ে নিয়ে এমন নিদারুণ নিষ্ঠুর ঠাট্টা কেউ করতে পারে!
তুমি খাটের কাছে এগিয়ে এলে, আমাকে টেনে নিলে তোমার বুকের মধ্যে। আমার নিঃশব্দ কান্নায় ভিজে গেল তোমার বুক। তারপর কোনও কথা না বলে বেরিয়ে গেলে আমার ঘর থেকে। এরপর আর কোনওদিনই আমার ঘরে এলে না। তোমার বিয়ে হয়ে গেল ১৮৮৩-র ৯ ডিসেম্বর। —আজ থেকে চার মাস আগে। আমার প্রাণের ঠাকুরপো, তোমার নতুনবউঠানের দিন ফুরালো। তার জীবনের শেষ দিন। আর তো সময় নেই আমার। মাথা ঘুরছে। চোখ বুজে আসছে। দৃষ্টি ক্রমেই ঝাপসা। আর বুকের ভেতরটা ঘামে ভিজে যাচ্ছে। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এল যে।
আমি দরজা বন্ধ করে দিয়েছি। আমি টেবিলের ওপর সাজিয়ে রেখেছি আমার সেলাইয়ের বাক্সটি।
আমি জানালার পাশে ফুলগাছের টবটিতে শেষবারের মতো জল দিয়েছি।
আমি আমার নাম-লেখা হাতপাখাখানি—ওটা রেখে গেলাম বালিশের ওপর।
গল্পের বইখানা, যেটি পড়ছিলাম ক’দিন ধরে, শেষ করতে পারলাম না, মাঝের পাতায় একটি চুলের কাঁটা গুঁজে রাখলাম—ওখানেই থামতে হল যে।
আর তোমার-আমার চিঠিগুলো সব ছড়ানো থাকল টেবিলের ওপর—আর তো লুকোবার কিছু নেই।
ঠাকুরপো, ওদের জ্বলতে দিও আমার সঙ্গে চিতায়।