আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের ক’দিন কেটেছিল তোমার সঙ্গে, ঠাকুরপো তোমার নীরবচ্ছিন্ন সংসর্গে, চন্দননগরে। তোমার সঙ্গে এমন মনোবাসের কোনও সুযোগ পাইনি আমি জোড়াসাঁকোর বাড়িতে।
মনে পড়ছে, সকাল থেকে বৃষ্টি সেদিন। তুমি আমাকে শোনাবে বলে সুর বসালে বিদ্যাপতির ‘ভরা বাদর মাহ ভাদর’ পদটিতে। বৃষ্টিপাত মুখরিত জলধারাচ্ছন্ন সেই মধ্যাহ্নে আমরা দু’জনেই গানে-সুরে-প্রেমে হয়ে গেলাম খ্যাপার মতো। ঠাকুরপো, তোমাকে কত আদর করেছিলাম, মনে আছে তোমার? আমরা দু’জনেই গান গাইতে-গাইতে বাগানের গাছপালার সঙ্গে সারা দুপুর ভিজেছিলাম। বৃষ্টি যেমন বাগানটিকে আচ্ছন্ন করেছিল, ঠিক তেমনি কি আমিও আচ্ছন্ন করিনি তোমাকে? মনে পড়ে তোমার? না কি নতুন বউ পেয়ে সব ভুলেছ?
কোনও-কোনও দিন আমরা সূর্যাস্তের সময় নৌকা করে বেরিয়ে পড়তাম।
একদিন তুমি বললে, ‘নতুনবউঠান, দ্যাখোদ্যাখো, পশ্চিম আকাশে সোনার খেলনার কারখানা একেবারে নিঃশেষে দেউলে হয়ে গিয়ে পূর্ববনান্ত থেকে চাঁদ উঠে আসছে। ‘
আমি বললাম, ‘ঠাকুরপো, এই মুহূর্তে আমি ধরণীর সবথেকে ভাগ্যবতী নারী। তোমার মতো পুরুষের সঙ্গে এমন সোনালি সন্ধ্যায় আর কোন নারী কবে কোন যুগে এমন ভেসে গিয়েছিল বলো?’
তুমি বললে, ‘ভাগ্যবান তো আমি নতুন বউঠান। একটু পরেই আমরা বাগানের ঘাটে ফিরে নদীতীরের ছাদটার ওপর বিছানা করে বসব—তুমি আর আমি। তখন জলে-স্থলে বিরাজ করবে শুভ্র শান্তি। নদীতে নৌকা প্রায় থাকবেই না। অন্ধকারে তীরের বনরেখা হয়ে উঠবে নিবিড়।
কথা শেষ করে ঠাকুরপো তুমি তাকিয়ে ছিলে আমার দিকে অনেকক্ষণ। আমার হঠাৎ মনে হয়েছিল, তোমার-আমার ইচ্ছে ছড়িয়ে আছে পশ্চিম দিগন্তে সূর্যডোবার রঙে।
ঠাকুরপো, সেদিনের সূর্যাস্তের রঙের সঙ্গে আজকের সূর্যাস্তের কোনও মিল নেই। আজ আমার জীবনের শেষ সূর্যাস্তের পরে নামবে নিবিড় অন্ধকার—সে অন্ধকার মৃত্যুর। সেই অন্ধকারের। মধ্যে শেষ হয়ে মিলিয়ে যাবে চন্দননগরের সব স্মৃতি—সেই দু’জনের কল্পনার রাজ্য, সেই মৃদু হৃদয়কথা কিংবা দু’জনে কোনও কথা না বলে শুধুইনীরবে বসে থাকা, সেই ভোরবেলার বাতাস, সেই সন্ধেবেলার গঙ্গা, নদীর ওপর সেই ঘনঘোর বর্ষার মেঘ, তোমার কণ্ঠে বিদ্যাপতির গান— সব মিলিয়ে যাবে মৃত্যুর নিবিড় অন্ধকারে।
রবি, যদি আমার মৃত্যুর অনেক বছর পরে তুমি কোনওদিন ফিরে আসো চন্দননগরের ওই বাড়িতে! যদি গিয়ে দেখো বেমেরামতি অবস্থায় সে-বাড়ি ভেঙে গিয়ে বনজঙ্গলে ঢেকেছে! সেদিনও হয়তো নতুন বর্ষা নেমেছে, সেদিনও হয়তো মেঘের ছায়া ভেসে চলেছে স্রোতের ওপর ঢেউ খেলিয়ে-খেলিয়ে—তোমার কি মনে পড়বে আমার চোখ দু’টি তখনও, গুনগুনিয়ে উঠবে। তোমার মনের মধ্যে এই গান—তোমার দু’খানি কালো আঁখি পরে বরষার কালো ছায়াখানি। পড়ে? তোমার মনের মধ্যে সেদিনও কি জেগে উঠবে বিদ্যাপতির পদ, ‘এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর?’
ঠাকুরপো, কী সব পাগলের মতন বকছি বলো তো? মনটা আমার একেবারে শিথিল হয়ে গেছে যে—আর যে লিখতে পারছি না ঠাকুরপো।
একটু আগেই আমি একটি একটি করে সবগুলো খেয়েছি। অনেকদিন ধরে জমিয়ে তোলা আফিমের গুলিগুলো। আর আমার পক্ষে ফিরে আসা সম্ভব নয়। সত্যিই চললাম।
মনে পড়ছে মোরানসাহেবের বাগানবাড়িতে রঙিন শার্সিতে ওই ছবিটা—পুরুষ আর নারী, দু’জনে দুলছে নিভৃত নিকুঞ্জে। তুমি বলেছিলে, নতুনবউঠান, দ্যাখো, ঠিক তুমি আর আমি।
মনে পড়ছে চন্দননগরের বাড়ির ছাদে সেই নির্জন গোল ঘরটা। সেই ঘর আমি নিজে হাতে সাজিয়ে দিয়েছিলাম তোমার জন্যে। তুমি বলেছিলে, ‘এই আমার কবিতার ঘর। লিখব আমি, শুনবে তুমি। ‘
তারপর কেমন ঘোর লেগে গেল তোমার। আমার খুব কাছে এসে দাঁড়ালে।
আমি ধীরে তোমার বুকের মধ্যে মুখটি খুঁজে ভুলে গেলাম আর সব কিছু। তুমি কি নিবিড় কণ্ঠে বললে :
‘অনন্ত এ আকাশের কোলে
টলমল মেঘের মাঝার
এইখানে বাঁধিয়াছি ঘর
তোর তরে কবিতা আমার। ‘
ঠাকুরপো, সেদিন কি তোমার সত্যিই মনে হয়েছিল আমিই তোমার কবিতা? তোমার বুকের মধ্যে যে কবিতার ঘরটি আছে, সেটি আমারই ঘর—আর কারও নয়! ঠাকুরপো, কোনওদিন সেই ঘরটি আর কোনও মেয়েকে আমি ছেড়ে দিতে পারব না, কিছুতেই না।
চন্দননগর থেকে কলকাতায় ফিরলাম আমরা। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি আমাদের দু’জনের জন্যেই যেন বদলে গেছে এই ক’দিনে। শুধু চাপা গুঞ্জন, বাঁকা দৃষ্টি। বিশেষ করে আমার পক্ষে জোড়াসাঁকোর বাড়ি দুর্বিষহ হয়ে উঠল। এই মধ্যে তুমি ‘ভারতী’ পত্রিকায় লিখলে সেই মারাত্মক লেখা—
‘সেই জানালার ধারটি মনে পড়ে, সেই বাগানের
গাছগুলি মনে পড়ে সেই অশ্রুজলে সিক্ত
আমার প্রাণের ভাবগুলিকে মনে পড়ে।
আর একজন যে আমার পাশে দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাকে মনে পড়ে। সে যে আমার খাতায় আমার কবিতার পার্শ্বে হিজিবিজি কাটিয়া দিয়েছিল, সেইটে দেখিয়া আমার চোখে জল আসে। সেই তো যথার্থ কবিতা লিখিয়াছিল।
এ লেখা প্রকাশিত হওয়ার পরেই আমি প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেলাম, আমার বাঁচার আর পথ নেই— তুমিই সে-পথ বন্ধ করে দিলে।
এর পরেই বাবামশায় তলব করলেন তোমাকে মুসৌরিতে। বললেন, তোমাকে অবিলম্বে বিয়ে করতে হবে। তুমি মাথা পেতে মেনে নিলে সেই অমোঘ আদেশ। ঠাকুরপো, টুশব্দটি করার সাহস হয়নি তোমার। না কি, তুমিও মনে মনে চেয়েছিলে বিয়েটা সেরে ফেলতে। যাইহোক, শুরু হল তোমার জন্যে মেয়ে দেখার পর্ব। আর কোথায়? সেই যশোরে!