তোমার নতুনদাদা লিখলেন নতুন নাটক অলীকবাবু। সেনাটকে আমি সুযোগ পেলাম একেবারে নায়িকার ভূমিকায়। জ্ঞানদানন্দিনী মোটেই ভালো চোখে দেখলেন না ব্যাপারটা। কিন্তু তাঁর তো আর নায়িকা হওয়ার বয়েস নেই। তাঁকে মেনে নিতেই হল নায়িকা হিসেবে আমাকেই। তাঁর প্রিয় দেওর ‘নতুন’-কে তিনি নিশ্চয় দু-চার কথা বলেছিলেন আমার বিরুদ্ধে–কিন্তু তেমন কোনও কাজ হয়নি তাঁর কথায়।
কিন্তু ওই নাটকে আমার প্রেমিক, অলীকবাবুর ভূমিকায় যে তুমি! আজ চিরকালের জন্যে চলে যাবার দিনে মনে হচ্ছে, সেটা ছিল একটা সূক্ষ্ম ফাঁদ। এবং আমি—একা আমি সেই ফাঁদে পা দিয়েছিলাম। নিজের সর্বনাশ আমি নিজেই ডেকে এনেছি ঠাকুরপো। তোমাদের কারও গায়ে কোনও আঁচড়, কোনও আঁচ লাগবে না কোনওদিন।
সেদিন বিকেলবেলা চলছে অলীকবাবু নাটকের মহড়া। মহড়ায় উপস্থিত স্বয়ং নাট্যকার। এসেছেন মেজবউঠাকরুণ নিজে। চেয়ারে বসেছেন তিনি। তাঁরই পায়ের কাছে, তাঁর হাঁটুতে হেলান দিয়ে বসেছেন আমার স্বামী। বোঝা যায়, তাঁদের বসার ভঙ্গি থেকে, তাঁদের নিবিড় অন্তরঙ্গতা।
ইতিমধ্যে প্রায় প্রতিদিন নাটকের মহড়া দিতে-দিতে প্রায় প্রতিদিন তোমার প্রেমিকার ভূমিকায় অভিনয় করতে-করতে, ক্রমশ আমিও ভুলতে শুরু করেছি যে আমি তোমার নায়িকা শুধুমাত্র এক সন্ধের মঞ্চে—তাই বাইরের সব ফাঁকা। কিছুতেই তা হতে পারে না—আমি তো তোমার সঙ্গে অভিনয় করিনি ঠাকুরপো—সত্যিই তো অত মানুষের সামনে মঞ্চের ওপর সেদিন আমার। হৃদয়ের বরমাল্য পরিয়ে দিয়েছিলাম তোমার গলায়—আমার সর্বনাশের পথে সেইদিনই পা ফেলেছিলাম নিশ্চিতভাবে।
মহড়ায় মেজবউঠাকরুণ আর আমার স্বামীকে ওইভাবে বসে থাকতে দেখে মাথায় দপ করে। জ্বলে উঠল আগুন। দেখলাম, মেজবউঠাকরুণ আমার দিকে বাজপাখির মতো তাকিয়ে আছেন। তখনও বুঝতে পারিনি, আমি তাঁর শিকার—সত্যি সত্যিই ঘনিয়ে আসছে আমার মৃত্যুর মুহূর্ত, এই নাটকের মহড়ায় রোপিত হয়েছিল আমার ধ্বংসের বীজ।
ঠাকুরপো, আমি মেজবউঠাকরুণকে যেন শুনিয়ে-শুনিয়ে সেদিন তোমার হাত ধরে, তোমার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে উচ্চারণ করলাম আমার স্বামীর লেখা এই লাইনগুলি।
’আমি জগতের সমক্ষে, চন্দ্রসূর্যকে সাক্ষী করিয়ে, মুক্তকণ্ঠে বলিব, লক্ষবার বলিব, তুমিই আমার স্বামী, শতবার বলিব, সহস্রবার বলিব, লক্ষবার বলিব, আমি তোমার স্ত্রী।
অন্যদিনও মহড়ার সময়ে কতবার বলেছি এই লাইনগুলি। কিন্তু সেদিন বলেছিলাম এমন আকুলতার সঙ্গে যে তুমিও তাকিয়ে রইলে আমার দিকে আমার কথা শেষ হওয়ার পরেও যাওয়ার দিনে বলে যাই, তোমার সেই নীরব আর্তিময় আঁখিপাতের মায়া ভুলতে পারিনি।
আমি তাকালাম মেজবউঠাকরুণের দিকে। চোখে তাঁর কী ঘৃণা! কী রাগ! কী ঈর্ষা! মনে হল, তুমি কি পারবে আমার হাত ধরে দাঁড়াতে এই ভয়ংকর প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে! সেই প্রথম ভয় দেখা। দিল আমার মনে-মৃত্যু ভয়।
মেজবউঠাকরুণ উঠে গেলেন মহড়া থেকে। কিছুক্ষণের মধ্যে চলে গেলেন তোমার নতুনদাদাও।
ক’দিনের মধ্যেই বাবামশায়ের কাছ থেকে আদেশ এল—আদেশ এল তোমার মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকেও—তোমাকে দ্বিতীয়বার বিলেত যেতে হবে ব্যারিস্টার হওয়ার জন্যে! আমি বুঝলাম, মেজবউঠাকরুণের অব্যর্থ চাল—আমার দাঁড়াবার কোনও জায়গা থাকল না। বাবামশায়ের আদেশ তো চাপা হুঙ্কার। রবি, তোমারই বা শক্তি কোথায় টুঁ শব্দটি করার!
ইতিমধ্যে ঠাকুরবাড়ির পরিবেশ দ্রুত বদলাতে লাগল। গানবাজনার সমাবেশ সরে গেল। মেজবউঠাকরুণের বাড়িতে। তোমার নতুনদাদাকেও ধীরে ধীরে সরিয়ে নিলেন তিনি আমার। কাছ থেকে, তাঁর প্রশ্রয়ে ও আশ্রয়ে। থিয়েটারের জগতের দিকে পা বাড়ালেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। তাঁর ঘনিষ্ঠতা বাড়ল নটীদের সঙ্গে। ঠাকুরবাড়ির মেয়েমহলে ব্যবহার আরও নিষ্ঠুর হয়ে উঠল। শুধু তোমার ভালোবাসার জোরে, তোমাকে কাছে পাওয়ার আনন্দে আমি বেঁচে রইলাম।
এই অবস্থায় তোমাকে দ্বিতীয়বার বিলেত পাঠাবার কথা উঠল। এই তো ফিরলে দু-বছর পরে। কী কষ্ট পেয়েছি দু-বছর তোমাকে একবারও না দেখে। আবার বিচ্ছেদ? একাকিত্ব? মনকেমনের কষ্ট? বুঝলাম, তোমাকে ছেড়ে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। ওই যন্ত্রণা আরও একবার সহ্য করার শক্তি আমার মধ্যে নেই। তোমাকে বললাম সে-কথা। কত করে অনুরোধ করলাম, যেও না ঠাকুরপো। আমাকে ছেড়ে যেও না। বাঁচব না আমি তোমাকে ছেড়ে।
তবু তোমাকে নিয়ে তোমার জাহাজ ছাড়ল বিলেতের পথে।
আমার রাগ হল। আমার অভিমান হল। অপমানিত মনে হল। আমার মনে হল, তোমাকে ভালোবেসে কষ্ট পাওয়ার শক্তি আমার ফুরিয়ে গেছে।
আমি আত্মহত্যার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সে-চেষ্টা আমার ব্যর্থ হল। সবাইকার চাপা হাসি আর করুণার মধ্যে আমি ফিরে এলাম জীবনে। কারও বুঝতে বাকি রইল না তোমার সঙ্গে ছাড়াছাড়ির কষ্ট সামলাতে না পেরে আমি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলাম।
আমার পক্ষে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে আর থাকা সম্ভব নয়। এ কথা বুঝেছিলেন আমার স্বামী। তিনিই আমাকে নিয়ে গেলেন চন্দননগরে মোরান সাহেবের বাগানবাড়িতে। তিনি আশা করেছিলেন হয়তো সেখানে গঙ্গার বাতাস আমার হৃদয় জুড়াবে। জুড়ালো হৃদয় জুড়ালো। গঙ্গার বাতাস লেগে নয়। যখন ফিরে এলে তুমি। বিলেত না গিয়ে, মাদ্রাজে জাহাজ থেকে নেমে সোজা। চলে এলে চন্দননগরে। ঠাকুরপো, তোমাকে আবার বুকে জড়িয়ে ধরে মনে হল কিছুক্ষণের জন্যে জীবনের বর্ণ-গন্ধ ফিরে এল। একথাও তখন নিশ্চিতভাবে আমি বুঝেছিলাম তোমার এই ফিরে আসার ফল ভালো হবে না। বাবামশায়ের শাসন আমাকে চুরমার করবে। তোমার জীবনও সুখের হবে না। বাবামশায় বেশিরভাগ সময়েই থাকেন হিমালয়ের পাদদেশে, ঈশ্বরচিন্তায় মগ্ন হয়ে। কিন্তু তাঁর নেপথ্য শাসনেই চলে ঠাকুরবাড়ি, তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস কারও নেই। সেকথা বোঝে বাড়ির ইট-কাঠ-পাথরও।