মনজুড়ে মনকেমনের মেঘের মধ্যে আবার চমকে উঠল বিদ্যুৎ। ঠাকুরপো, আবার মনে পড়ে গেল অন্য এক পূর্ণিমার রাত, ওই নন্দনকাননেই। চারধারে চাঁদের আলো। চারধারে ফোটাফুলের মেলা। তারই মধ্যে এসে দাঁড়ালে তুমি—দীর্ঘাঙ্গ, ঋজু, সুঠাম। তোমার নতুনদাদা খুবই রূপবান পুরুষ। কিন্তু তোমার রূপে আগুন আছে রবি-সে-আগুন তোমার প্রাণের, তোমার গানের, সে-আগুন ছড়িয়ে যায় সবখানে, সেই আগুনেই পুড়েছি আমি, আরও কত নারী পুড়বে তোমার চলার পথে-পথে। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে নন্দনকানন। তুমি এসে দাঁড়ালে। সেখানে। মনে হল, পূর্ণিমার গায়ে আগুন লাগালে।
সেই আগুন আমার চোখে চোখ রাখল। সেই আগুন আমার কাঁধে হাত রাখল। সেই আগুন তার বুকের মধ্যে আমাকে বলল—’নতুনবউঠান, তোমাকে আমার হৃদয়কথা জানিয়ে একটি গান লিখেছি আজ, তাকে বসিয়েছি ‘ছায়ানট’ রাগিনীতে। ‘ সেই আগুন সত্যিই গেয়ে উঠল—
পৃথিবীতে শুধু আমারই জন্যে :
তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা,
এ সমুদ্রে কভু হব নাকো পথহারা।।
যেথা আমি যাই নাকো তুমি প্রকাশিত থাকো,
আকুল নয়নজলে ঢালো গো কিরণধারা।।
তব মুখ সদা মনে জাগিতেছে সংগোপনে,
তিলেক অন্তর হলে না হেরি কূল-কিনারা।
কখনো বিপথে যদি ভ্রমিতে চাহে এ হৃদি
অমনি ও মুখ হেরি শরমে সে হয় সারা।।
রবি, তোমার কণ্ঠে এ-গান আমার চেতনার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শুনবে আমার বিশ্বাসহীন, বিক্ষত হৃদয়। তোমার মনে আছে কী বলেছিলে, কেমনভাবে বলেছিলে তুমি আমাকে গানের কথাগুলি? আমি তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে, তোমার বুকের ওপর মাথা রেখে, তোমার আগুনে পুড়তে পুড়তে বিশ্বাস করেছিলাম রবি, আমি সত্যিই তো তোমার জীবনের ধ্রুবতারা, আর কোনও পথ তোমাকে ডাকবে না, ডাকলেও সাড়া পাবে না তোমার, জীবনসমুদ্রে তোমাকে আমি, আমাকে তুমি, হারাব না কোনওদিন। বিশ্বাস করেছিলাম, তুমি যেখানেই যাও যার কাছেই থাকো, তোমার জীবনে আমার প্রকাশ আর কখনও অন্য কোনও প্রেম আচ্ছন্ন করে দেবে না। বিশ্বাস করেছিলাম, ঠাকুরপো, তুমি বোঝো আমার দহন, আমার কান্নার মর্যাদা আছে একমাত্র তোমার প্রেমে আমার নয়নজলের আলো সত্যিই তুমি বুঝি দেখতে পাও। ঠাকুরপো, আমার সহজ সরল ভালোবাসা বিশ্বাস করেছিল, আমি তোমার জীবন থেকে যদি মুহূর্তের জন্যেও সরে যাই, জীবনসমুদ্রে হারিয়ে ফেলবে তুমি কূলকিনারা। আমার মুখ সর্বদা জেগে আছে সংগোপনে। তোমার মনের মধ্যে, সেখানে অন্য কোনও মুখ যদি হঠাৎ দেখা দেয়, তুমি লজ্জায় মরে যাবে ঠাকুরপো–এ-কথা বিশ্বাস করেছিলাম আমি।
আমি কেমন কবে বিশ্বাস করব বলো, মাত্র ক’মাসের মধ্যে তুমিই বদলে যাবে এতটা—লিখতে পারবে—
হেথা হতে যাও পুরাতন।
হেথায় নতুন খেলা আরম্ভ হয়েছে!
আমার হৃদয় শুধু বলছে, অসম্ভব এ অসম্ভব। ঠাকুরপো, আজও তো শ্রাবণের মেঘ কালো হয়ে নামে বনের মাথায়। আজও তো খর বিদ্যুৎ খানখান করে রাতের বক্ষ, আজও তো বুকের মধ্যে শুনেত পাই বারুণীনদীর তরল রব, শুনতে পাই রিমঝিম ঘন বর্ষণে সমস্ত প্রকৃতি জুড়ে কাজরি গাথা, আজও তো তোমার বাহুতে মাথা রেখে তোমার সঙ্গে আবার দেহে মনে এক হয়ে যেতে ইচ্ছে হয় ঠাকুরপো—তবু আমার টুকরো-টুকরো হৃদয় শুধু বলছে, অসম্ভব সে অসম্ভব! ঠাকুরপো কেন এমন হল? কেন তুমি কথা রাখলে না? আমি যে তোমাকে বড্ড বিশ্বাস করেছিলাম রবি।
প্রাণের রবি, তুমি ফিরে এলে বিলেত থেকে। ঠাকুরবাড়িতে এল গান-বাজনার, আনন্দের সৃজনের, মননের নতুন যুগ। ১৮৮২-র মধ্যে সত্যিই ঠাকুরবাড়িতে ঘটল সংস্কৃতির নবজাগরণ। আর তোমার প্রেমের প্রেরণায় সেই সমারোহের কেন্দ্রে সরে এলাম আমি! শ্যাম গাঙ্গুলির তিন নম্বর মেয়ে। যার না আছে শিক্ষার গৌরব। না আছে রূপের জৌলুস। রবি, তুমি আমাকে ভালোবাসলে বলেই তো তোমার হাত ধরে আমি দাঁড়ালাম সেইনবজাগরণের প্রাণদুহিতা হয়ে। তোমার সুরে-গানে-কবিতায়-নাটকে হইচই ফেলে দিলে তুমি–তোমার প্রাণের বন্যায় ভেসে গেল যেন সারা বাংলাদেশ। আর আমি তোমার অলৌকিক সুজনস্রোতে জলকন্যার মতো ভাসতে লাগলাম। মনে হল সবাইকে বলি, দুয়ো দুয়ো দুয়ো। তুমি একদিন বাড়ির থিয়েটার মঞ্চের পরদার আড়ালে আমার কানের লতিতে ছোট্ট কামড় বসিয়ে বললে, ‘নতুনবউঠান, তুমিই আজ থেকে বঙ্গমজলিসের মক্ষ্মীরানি—এ তোমার পাকা আসন। জেনে রেখো। ‘
এতদিন যিনি কেন্দ্রে ছিলেন, যিনি তাঁর বিলিতি শিক্ষাদীক্ষার গৌরবে ভেবেছিলেন এটি তাঁরই পাকা আসন, তিনি মেজবউঠাকরুণ।
ঠাকুরপো, যেদিন জ্ঞানদানন্দিনীর চোখে দেখলাম আগুন—রাগ, অভিমান, ঈর্ষার আগুন—যে আগুন ক্ষণে ক্ষণে বর্ষিত হতে লাগল আমারই ওপর, সেদিন যে ভয় করেনি, তা নয়। মনে হয়েছিল এ-বাড়িতে যদি কেউ আমার সর্বনাশ চান তো তিনি! তবু তুমি ছিলে আমার একান্ত আশ্রয়, আমার পরম ভরসা। আমি সবাইকে দেখিয়ে দিতেও চেয়েছিলাম, যে-মেয়েটিকে ওঁরা কোনওদিন দিলেন না ঠাকুরবাড়ির যোগ্যতার মর্যাদা, যে-মেয়েকে অপমানিত হতে হয়েছিল পদে পদে, সেই মেয়েই পারল ঠাকুরবাড়ির ভাবনাভুবনের চাবিটি তার আঁচলে বাঁধতে। তুমি আমার হাত ধরেছিলে বলেই আমার সমস্ত সাধারণত্ব পেরিয়ে আমি উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। ইচ্ছাপূরণের এক অলীক তুঙ্গে। তখন কী জানতাম ঠাকুরপো, আমি আসলে পুঁতেছি আমার বিজয়বৈজয়ন্তী চোরাবালির ওপর!