তাই মিস-দ্বয়কে একটি গান গেয়ে শোনালাম।
আমার গান দুই ‘মিস’-এরই ভালো লাগল বলে মনে হল। ছোট ‘মিস’ আমাকে গানটি ইংরিজিতে অনুবাদ করে বলতে অনুরোধ করলেন। আমি অনুবাদ করলেম–বউঠাকরুণ, গানটি হল— প্রেমের কথা আর বোলো না।
ঠাকুরপো, তোমার এই দীর্ঘ চিঠিটি পড়তে-পড়তে আমি অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, তুমি যেন আর আমার সেই চেনা মানুষটি নও। বিলেত তোমাকে অনেক বদলে দিয়েছে। এদেশে ফিরে এসে তোমার এই নতুনবউঠানকে আর ভালো লাগবে না। এক পাগল হাওয়ার বাদল দিনে তুমিই আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলে ঠাকুরপো, আমার চোখের চাওয়ার হাওয়া দোলায় তোমার মন। বলেছিলে, আমি আছি বলে তোমার ভাষায় লাগে সুরের আবরণ। বলেছিলে, আমার ছোঁয়ায় তোমার হৃদগগণে দেখা দেয় সোনার মেঘের খেলা। নীলনয়নাদের দেশ থেকে ফিরে বাংলার এই কালো মেয়ের চোখের চাওয়ায়, শরীরের স্পর্শে আর কি কিছুই পাবে তুমি? এইসব কথা ভাবতে-ভাবতে আমি অমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। ছোট্ট উর্মিলা যে কখন আমার চোখের আড়ালে চলে গেছে, খেয়াল করিনি। সে নড়বড়ে পায়ে ছাদের পিছনে লোহার ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নীচে যাচ্ছিল। টাল সামলাতে পারল না। পড়ে গেল গড়াতে-গড়াতে। মাথায় লাগল আঘাত। হঠাৎ নীচে কাজের লোকদের চেঁচামেচিতে আমার ঘোর ভাঙল। আমি দৌড় নীচে গেলাম। উর্মিলা ততক্ষণে নিথর হয়ে গেছে। তার প্রাণটুকু বেরতে বেশি সময় লাগেনি। সেই থেকে নিজের কাছে বড় অপরাধী হয়ে আছি। দায়ী করছি নিজেকে। আমার পাপের জন্যই কি মরতে হল ঊর্মিকে? ঠাকুরপো, তোমার প্রতি আমার এই প্রেম—এ অন্যায়, অন্যায়। একদিন উর্মিকে মরতে হল। আজ আমাকে মরতে হচ্ছে। হয়তো তুমিও কষ্ট পাবে, তছনচ হবে আজীবন।
আমার প্রাণের রবি, বেলা পড়ে আছে। বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে সন্ধের দিকে। আমার জীবনের শেষ সূর্যাস্ত, শেষ সন্ধে। সেই সকাল থেকে লিখছি। মনের মধ্যে ক্রমশ জমে উঠছে মেঘ, স্মৃতির বিদ্যুৎ চমকে উঠছে ঝোড়ো বাতাসে। মনে পড়ছে, দু-বছর পরে ফিরে এলে তুমি বিলেত থেকে। শেষ হল আমার বিরহের বেলা, আকাশকুসুম চয়ন। জোয়ার এল আমার জীবনে–তোমাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দের জোয়ার। তুমিও যেন গানে সুরে কবিতায় প্রেমের উজান হয়ে ফিরে এলে। আমরা আমাদের প্রাণের খুশি কিছুতেই চেপে রাখতে পারিনি। প্রকাশ ঘটল তার। আকাশে-বাতাসে, লতায়-পাতায়, দিনের আলোয়, রাতের অন্ধকারে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি হঠাৎ উপচে পড়ল তোমার-আমার প্রাণের সুন্দনে। তুমি তখন উনিশ। আমি একুশ। ঠাকুরপো, শুধু তুমি তো ফিরে এলে না, আমার মনে হল, তুমি আমার জীবনে ফিরিয়ে আনলে সেই চাঁদ, সেই ছাদ, সেই দক্ষিণে বাতাস। তুমি লিখতে লাগলে রোজ নতুন-নতুন গান আমারই জন্যে, আমারই প্রেরণায়! দুপুরবেলা আমার পাশে খাটে বসে বসে কত কবিতা লিখতে তুমি—ছবির মতো ভেসে উঠছে সেই সব স্মৃতি। মনের মধ্যে ক্রমেই ঘন হচ্ছে মনকেমনের বাদল। ওই ঘন মেঘ আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে অন্য কথা—তোমার ফিরে আসার পর গড়ে উঠল তোমার আমার এক গাঢ় গহন গোপন ভুবন। সেই পৃথিবী শুধু তোমার-আমার, আর কেউ নেই সেখানে, কারোর প্রবেশাধিকারই নেই।
তোমার-আমার প্রেমের প্রথম প্রকাশ ঘটল একটি বাগানের মধ্যে। সেই বাগানের গাছে-গাছে। ফুটে উঠল আমাদের ভালোবাসা, ফুলে-ফুলে রঙিন হয়ে থাকল আমাদের প্রাণের বাসনা। তুমি সেই বাগানের নাম দিলে নন্দনকানন—আমার ঘরের সামনে ছোট্ট ছাদটিতে দু’জনে মিলে তৈরি করলাম সেই বাগান।
আমরা দু’জনে কত সন্ধে-রাত কাটিয়েছি সেই নন্দনকাননে। দিনের শেষ সেখানে যেতাম গা ধুয়ে প্রসাধন শেষ করে তোমার গান শোনার জন্যে তৈরি হয়ে। সেখানে পাততাম মাদুর। মাদুরের ওপর তাকিয়া। খোঁপায় লাগাতাম বেলফুলের মালা। বেঁধে দিতাম তোমার কবজিতে বেলফুলের রাখি। আর বেলফুলের একটি গড়ে মালা ভিজে রুমাল দিয়ে ঢেকে রেখে দিতাম রূপোর রেকাবিতে। যেদিন হত পূর্ণিমা, সেদিন যে কী রূপ খুলত এই পরিবেশের! সব মনে পড়ছে আমার।
দক্ষিণের আকাশ থেকে উড়ে আসত হু-হু বাতাস। হঠাৎ গান গাইতে-গাইতে তোমার আবির্ভাব হত—যেন দেবদূত! তোমার সেই গান ছড়িয়ে পড়ত আকাশভরে, তারায়-তারায়।
একদিন হঠাৎ তুমি বললে, ‘নতুনবউঠান, শুধু গান শুনলেই হবে না গো, গলা মেলাও আমার সঙ্গে।
আমি পড়ে গেলাম মহা বিপদে। সংকোচ গলা চেপে ধরল আমার। বললাম, ‘ঠাকুরপো, এ তোমার অন্যায় অনুরোধ, তোমার কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মেলানোর কণ্ঠ কোথায় আমার?
তুমি বললে, ‘নতুনবউঠান, ভেব না তোমার গান আমি লুকিয়ে চুরিয়ে শুনিনি। একটা কথা তোমাকে জানাই বউঠান, আমার গান তোমার মতন করে পৃথিবীর আর কোনও মেয়ে গাইতে পারে না। সুর যে তোমার রক্তে। তুমি সুর পেয়েছ জন্মসূত্রে, তোমার ঠাকুরদা জগন্মোহন গঙ্গোপাধ্যায় রাগসংগীতের সাধক, তোমার কণ্ঠে উপচে পড়ছে সুর–কণ্ঠ মেলাও আমার সঙ্গে, জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে শুরু হোক সংগীতচর্চার নতুন যুগ। ‘
ঠাকুরপো, একমাত্র তোমারই জন্যে আমি গেয়েছি—গেয়েছিল আমার প্রেম, আমার আদর। আমার প্রাণে যতটুকু সুর ছিল সব দিয়েছিলাম তোমাকেই। সে-গান কতদিন হল বন্ধ হয়ে গেছে। ঝরে গেছে নন্দনকাননের প্রাণ। অথচ একদিন আমার গান শেষ হতেই আমার দুটি হাত ঘনভাবে ধরলে তুমি তোমার হাতের মধ্যে, তোমার বুকের ওপর, যেন তোমার প্রাণের ওপর। রাখলে আমার হাত, বললে, ধরণীতলে যে-ভাষায় শুধু তুমিই কথা বলতে পারো, ‘নতুনবউঠান, কোমল তব কমলকরে, পরশ কর পরানপরে। ‘