তুমি কি সত্যি বোঝো না ঠাকুরপো বুকের মধ্যে তোমার জন্যে যে-মনকেমন, যে-কষ্ট আমি দিনরাত চেপে রাখি? আমি জানি ঠাকুরপো, তুমি বোঝো। অন্তত একদিন বুঝতে…ক’মাস আগে পর্যন্তও…
তুমি যে আমার ছেলেবেলার খেলার সাথি।
রবি, তোমাকে চিরদিনের জন্যে ছেড়ে যাওয়ার আগে মনের কথাটি জানিয়ে যাই। কোনও মিথ্যে নেই এ-কথার মধ্যে। আমি বানানো কথা বলতে শিখিনি।
তোমাকে, শুধু তোমাকেই ভালোবেসেছি।
তোমার মতো আর কোনও পুরুষ যে আমি দেখিনি ঠাকুরপো। রূপে গুণে, গান আর প্রাণের প্লাবনে তুমি যে অনন্য।
তোমার এই পঁচিশ বছরের বউঠাকরুণটি তোমাকে চিরদিনের জন্য ছেড়ে যাওয়ার আগে তোমাকে বলে যাচ্ছে—তুমিই তার একমাত্র অবলম্বন ছিলে এ-সংসারে। একমাত্র ভালোবাসার পুরুষ।
ঠাকুরপো, সেদিন ছিল জ্যোৎস্নারাত। জোড়াসাঁকোর বাড়ির ছাদে শুধু তুমি আর আমি। তুমি গাইছিলে গান। আমার সেদিন মন ভালো ছিল না। তোমাকে বলিনি সেকথা। তবু তুমি বুঝতে পারলে আমার মনের কষ্ট। তুমি যে আমার দোসর ঠাকুরপো। আমার কানের কাছে মুখ এনে গাঢ় স্বরে বললে, ‘নতুন বউঠান, কী হবে ছোটখাটো দুঃখের কথা মনে রেখে? ভুলে যাও, সব ভুলে যাও। ‘
‘ভুলতে বললেই কি ভুলতে পারা যায়? কতদিনের কত অপমান, কত কষ্ট, সেই ন’বছর বয়সে তোমাদের বাড়ি বউ হয়ে এসে পর্যন্ত সহ্য করছি’ বলেছিলাম আমি।
তুমি আমার হাতের উপর হাতটি রেখে শুনশান বিশাল ছাদটির এক কোণে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে। তারপর বললে, ‘নতুন বউঠান, জ্যোতিদাদা এখনও আসেনি বুঝি?’
‘আজকাল তোমার জ্যোতিদাদার বাড়ি আসার কোনও সময় নেই। কখন আসেন কখন যান, আমার সঙ্গে দেখা হয় কতটুকু। কাল রাত্রে তো…’
‘জানি, মেজবউঠাকরুণের ওখানে গানবাজনার আসর বসেছিল। আমিও ছিলাম কিছুক্ষণ। জ্যোতিদাদাই তো সেই আসরের প্রাণপুরুষ। জ্যোতিদাদা যে সেই মজলিশ ছেড়ে আসতে
পারবে না, সেটা বুঝতে পেরেছিলুম। ‘
‘জ্যোতিদাদার দিনরাত আজকাল মেজবউঠাকরুণের কাছেই কাটে। ‘
কথাটা তোমাকে বলতে খুব কষ্ট হয়েছিল আমার ঠাকুরপো। তুমি কোনও উত্তর দিলে না।
আমি বললাম, ‘শুধু তোমার জন্যে বেঁচে আছি ঠাকুরপো।
আমার বেঁচে থাকার আর কোনও কারণ নেই। ‘
ঠাকুরপো, একথা শুনে তুমি আমার দিকে তাকালে। তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে আমার ভয় করল।
আমার মনে পড়ছে, চাঁদের আলোয় তোমার সেই রূপ। যেন এক তরুণ দেবদূত। কিন্তু তোমার চোখের দৃষ্টি আমাকে শান্তি দিল না। মনে হল, আমার শেষ আশ্রয়টুকুও চলে যাবে। ঠাকুরপো, সেই রাত্রে চাঁদের আলোর মধ্যে তোমার বুকে মাথা রেখে আমি আরও একবার নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারলাম, তুমি আমার জীবন থেকে চলে গেলে আমি বাঁচব না, বাঁচতে পারব না।
তুমি আমাকে নিবিড় করে জড়িয়ে ধরলে। কিন্তু সেই আলিঙ্গনের মধ্যে কোনও আশ্রয় পেলাম না —যে-আশ্রয় আমি চেয়েছিলাম। আমি কেঁদে তোমার বুক ভাসিয়ে ছিলাম। চাঁদের আলো মিশে গেল আমার কান্নায়।
তোমার দিকে মুখ তুলে দেখি তোমার চোখেও জল—সেই প্রথম তোমার চোখে জল দেখলাম ঠাকুরপো। চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে তোমার চাপা কান্না।
আমি বললাম, ‘ঠাকুরপো, তোমার জন্যে আমার মন এতদিন ধরে যে-মালা গেঁথে রেখেছে, আজ এই চাঁদকে সাক্ষী করে সেই মালা তোমার গলায় পরিয়ে দিলাম। তুমি তোমার জীবনে আমাকে বরণ করে নাও। ‘
তোমার চোখের জল নিঃশব্দে ঝরে পড়ল আমার কপালে, আমার গালে, আমার বুকের ওপর।
প্রাণের ঠাকুরপো, জীবনের এই শেষ দিনে, তোমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে, অনেক কথা মনে পড়ছে। কত কথা, স্মৃতি, হতাশা, অপমানের বেদনা, একাকিত্বের কষ্ট—সব জমে আছে বুকের মধ্যে। অনেক কথা তুমিও জানোনা।
কিন্তু মৃত্যু যতই কাছে এগিয়ে আসছে, বিদায়ের ঘণ্টা যতই শুনতে পাচ্ছি, ততই যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে মন, ভাবনারা সব ছড়িয়ে যাচ্ছে, তাদের ওপর আমার শাসন ক্রমশই আলগা হয়ে যাচ্ছে। মনের এই অবস্থায় গুছিয়ে লেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয় ঠাকুরপো। কিন্তু তবু। লিখতে আমাকে হবেই। না লিখেও আমার মুক্তি নেই গো।
কোথা থেকে শুরু করব বলো তো? ১৮৫৯-এ ৫ জুলাই আমার জন্ম থেকে? ঠাকুরপো, কেন তোমাদের মতো অভিজাত ধনী পরিবারে জন্ম হল না আমার? তাহলে তো এত অপমান সহ্য করতে হত না।
ঠাকুরপো, আমার অপমানের গল্প কিন্তু শুরু হয়েছিল আমার জন্মের আগে থেকেই। সেকথা হয়তো তুমিও জানো, কিন্তু কোনওদিন কোনওভাবে বুঝতে দাওনি, পাছে আমি কষ্ট পাই। একদিন শোওয়ার ঘরে দুপুরবেলা একাই শুয়েছিলাম আমি। শুধু মনে আসছিল পুরোনো কষ্টের কথা। কান্না কিছুতেই রাখতে পারছিলাম না। হঠাৎ এলে তুমি। হাতে তোমার কবিতার খাতা। নিশ্চয় নতুন কোনও কবিতা বা গান লিখেছ। শোনাতে চাও আমাকে। আমিই তো সব সময়ে ছিলাম তোমার প্রথম শ্রোতা, এই সেদিন পর্যন্ত। তুমি আমার চোখে জল দেখে থমকে দাঁড়ালে। খাতাটি খাটের পাশে টেবিলটার ওপর রেখে বসলে আমার পাশে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলে। আমার চোখের দিকে। আমি আলতো করে হাত রাখলাম তোমার বুকের ওপর। মনে হল, ভেতরটা আমার জুড়িয়ে গেল।
তুমি আমার কপালে হাত রেখে বললে, ‘নতুন বউঠান, পুরোনো চিঠির মতো পুরোনো কষ্টও ধুলায় হোক ধূলি। ‘ সেই মুহূর্তটি আজ জীবনের শেষ দিনে মনে পড়ছে বারবার। ঠাকুরপো, আর কেনওদিনই কি ফিরে আসবে না আমার প্রতি তোমার প্রেম, তোমার মনের আদর, ফিরে আসবে না তোমার সঙ্গে নন্দনকাননে সেই সব অমল সকাল, শোওয়ার ঘরে সেইসব নিঝুম দুপুর, দক্ষিণের বারান্দায় সেইসব বর্ণিল বিকেল, ছাদের ওপর স্নিগ্ধ সন্ধে থেকে মগ্ন রাত? ফিরে আসবে না তোমার আমার এক সঙ্গে কবিতা পাঠ, গান গাওয়া? তুমি আরও একবার আমার হবে আমার সব হারানোর মধ্যে? যা ভাঙল তা ভেঙেই গেল?