তুমি বললে, ‘নতুনবউঠান, তুমি আমার জীবনে আসার আগে কিন্তু বুঝিনি মেয়েরা কত ভালোবাসা, কত আদর ঢেলে দিতে পারে একটা পুরুষের জীবনে। আমি এ-বাড়ির কালো ছেলে। সেই কালো ছেলেকে তুমি এমন ভালোবাসলে কী করে?’
এ-কথা শুনে আমি তোমার হাতটি নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে আমার বুকের মধ্যিখানটিতে রেখে দিলাম অনেকক্ষণ। মনে হল সেখানকার জ্বালা একটু কমছে।
ঠাকুরপো, ১৮৭৮ থেকে ১৮৮০—এ-দু’বছরে আমি একটি কথা ক্রমে বুঝতে পেরেছিলাম, তোমাকে না পেলে আমার পক্ষে বেঁচে থাকা অসম্ভব। এই দু-বছর তুমি ছিলে বিলেতে। আর আমি ছিলাম দিনরাত তোমার বিরহে। যত দিন গিয়েছে, তত বেশি কষ্ট পেয়েছি। এত কষ্ট হয়তো পেতাম না, যদি আমার একটি সন্তান থাকত। তাকে অবলম্বন করেই না হয় বাকি। জীবনটুকু কাটিয়ে দিতাম। ঠাকুরপো, সন্তান না-হওয়ার সব দায়িত্বই, সব অক্ষমতাই আমার ওপর বর্তালো। কোনও ডাক্তারিপরীক্ষা হয়নি, অথচ আমাকেই বহন করতে হল বন্ধ্যাত্বের বদনাম। তোমাকে সব কথা বলতে পারব না, কিন্তু এই বদনাম সহ্য করার নিঃসঙ্গ অপমান থেকে কেউ আমাকে বাঁচালেন না—তোমার নতুনদাদাও নন! আমার যে সন্তান হল না তার জন্য জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির নির্মম পরিবেশে আমিই দায়ী রয়ে গেলাম চিরকাল!
ঠাকুরপো, তুমি যখন বিলেতে, তখন কিছুদিনের জন্য আমার কোলজুড়ে, বুকজুড়ে পেলাম। তোমার ন’দিদি স্বর্ণকুমারীদেবীর ছোট্ট মেয়ে ঊর্মিলাকে। সে সারাদিন থাকত আমার কাছেই। যেন আমিই তার মা। আমি তাকে খাওয়াতাম, পড়াতাম, শোয়াতাম, খেলতাম তার সাথে। আমি তার মামি। হয়ে উঠলাম না। মাতৃত্বের সেই স্বাদ ক্ষণিকের জন্য এসেছিল আমার জীবনে তা কোনওদিন আমার পক্ষে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।
সেটা ছিল ১৮৭৯-র ৩১ ডিসেম্বর—আমার জীবনের এক ভয়ঙ্কর দিন। তোমার চিঠি এসেছিল বিকেলের ডাকে। এই তো সেই চিঠি—একেবারে আমার চোখের সামনে–
‘নতুনবউঠান,
এদেশে যে মেয়েরা সুন্দরী তাঁরা জানেন, তাঁরা সুন্দরী। বিলেতে আত্মসৌন্দর্য-অনভিজ্ঞা যুবতী দেখবার জো নেই। এখানে সৌন্দর্যের পূজা হয়। আমাদের দেশের পুরুষ এইভাবে নারীর তনুশ্রীর প্রকাশ্য পূজা করতে হাজার কুণ্ঠায় ভোগেন। তাই আমাদের দেশের সুন্দরীরা বিশ্বাস করতে শেখেননি তাঁরা সুন্দরী। তাঁদের শারীরিক আবেদনের অনেকটাই তাই মাঠে মারা যায়। বিলেতে ঠিক উলটো। এখানে রূপ কোনওমতে গুপ্ত থাকতে পারে না। রূপাভিমান সুপ্ত থাকতে পারে না। চারদিক থেকে প্রশংসার কোলাহল তাকে জাগিয়ে তোলে। রূপের আলো দেখবা মাত্র ভক্তদের পতঙ্গহৃদয় চারদিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে তাকে ঘিরে ফেলে ও রূপসী যেদিকে যান সেই ফড়িঙের দল তার চতুর্দিকে লাফিয়ে চলতে থাকে। বল-রুম নৃত্যে সুন্দরী রমণীর দাম অত্যন্ত। চড়া। নাচে সেই রমণীর সান্নিধ্যসুখ পাওয়ার জন্যে দরখাস্তের স্রোত বইতে থাকে। তাঁর হস্তচ্যুত রুমাল কুড়িয়ে দেওয়ার জন্যে পুরুষের শত শত মুগ্ধ হাত প্রস্তুত। তাঁর তিলমাত্র কাজ করে দেওয়ার জন্যে শত পুরুষ কায়মনোবাক্যে দিবারাত্রি নিযুক্ত। নতুনবউঠান, এই তো গেল রূপসীদের চড়া দামের কথা। এবার আমার মতো রূপবান তরুণদের প্রসঙ্গে আসা যাক। বলরুম-নৃত্যে তোমার এই দেওরটিরও যথোচিত আদর আছে। আমি এখানকার কিছু-কিছু ড্রয়িংরুমের ডারলিং হয়ে উঠেছি—এ-কথা বললে খুব একটা মিথ্যে বলা হবে না। তবে একথা বলছিনা যুবতীরা ইতিমধ্যেই আমাকে তাদের আদর দিয়ে-দিয়ে অনর্থ করে তুলেছে—যদিও অদূর ভবিষ্যতে সেই সম্ভাবনা নেই এমন কথাও বলছি না।
নতুনবউঠান, আমি নিশ্চিত এ-কথা শুনে তোমার এখানে আসতে অত্যন্ত লোভ হবে। তোমার মতো শ্যামল সুন্দরী বিলেতের মতো রূপমুগ্ধ দেশে এলে এখানকার হৃদয়রাজ্যে এত ভাঙচুর লোকসান হতে পারে যে, সে একটা নিদারুণ করুণরসোদ্দীপক ব্যাপার হয়ে উঠবে। হে আমার বউঠাকরুণ, এদেশে এমত অবস্থায় তোমার হৃদয়টিকেও যে খরচের খাতায় লিখতে হবে! এদেশে এলেই বুঝবে, এখানে রূপের মতো সুপারিশপত্র আর নেই। আমাদের দেশের রূপবতীদের ভাগ্য নিতান্তই মন্দ। তাদের রূপ অন্দরমহলের চৌহদ্দি পেরতে পারে না। বাইরের জগতে সেই রূপের কোনও অধিকার নেই। আধিপত্য নেই।
এবার এদেশে আমার অবস্থার একটু বিশদ বিবরণে আসা যাক। বিলেতে আমার বিশেষ ভাব হয়েছে দুই সুদর্শনা ‘মিস’-এর সঙ্গে। একটি নিমন্ত্রণসভায় এই দুই রূপসীশ্রেষ্ঠ ‘মিস’ কেমন চুপচাপ গম্ভীর হয়েছিলেন। ছোট ‘মিস’ একটা কৌচে গিয়ে হেলান দিয়ে বসলেন, আর বড় ‘মিস’ দেয়ালের কাছে এক চৌকি অধিকার করলেন। এদের এই গাম্ভীর্যের কারণ হয়তো এই যে আমি ছাড়া ঘরে আর কোনও যুবক ছিল না। তরুণনেত্র তাঁদের রূপ ও সাজসজ্জা যেমন উপভোগ করতে পারে এমন তো আর চশমাচক্ষু পারে না। যাইহোক, আমি যতদূর সম্ভব ‘মিস’-দ্বয়কে। আমোদে রাখবার জন্যে নিজেকে নিযুক্ত করলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমি কথোপকথন শাস্ত্রে তেমন বিচক্ষণ নই। এখানে যাকে উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব বলে, তাও নই। অনর্গল গল্প হাসি আসে না। আকারে-ইঙ্গিতে কথার আভাসে আমি রূপসীকে জানিয়ে দিতে পারি না যে, আমার চকোরনে তাঁর রূপের জ্যোৎস্না ও আমার কর্ণচাতক তাঁর বাক্যধারা পান করে স্বর্গসুখ ভোগ করছে।