এই প্রণয়কুঞ্জেই আকস্মিক দেখা পেয়েছি তার! তাকে দেখে একেবারে চমকে উঠেছি আমি— এই শত শ্বেতাঙ্গিনীদের মধ্যে একটি ভারতবর্ষীয়া শ্যামাঙ্গিনী রয়েছে। দেখেই তো আমার বুকটা একেবারে নেচে উঠল। তার সঙ্গে কোনওমতে আলাপ করবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেম। কতদিন। শ্যামলা মুখ দেখিনি! সত্যি বলছি বউঠান, তোমার মুখটা তোমার চোখ দুটো তাই এই শ্বেতাঙ্গিনীদের দেশে বারেবারে মনে পড়ে। তবে এই শ্যামাঙ্গিনীর মুখটি তোমার মতো নয়, এর মুখে আমাদের বাঙালি মেয়েদের ভালোমানুষি নম্রভাবে মাখানো। তোমার চোখেমুখে। নতুনবউঠান যে ধীময় দুষ্টুমির ভাবটি আছে, তা নেই এই শ্যামাঙ্গিনীর মুখে। মেয়েটির চুল বাঁধা আমাদের দেশের মতো। সাদা মুখ আর উগ্ৰ অসংকোচ সৌন্দর্য দেখে দেখে আমার মনের ভিতরটা ভিতরে ভিতরে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল—এতদিনে তাই বুঝতে পারলেম। নতুনবউঠান, বিকেল চারটে বাজতে চলল, তবু অন্ধকার হয়ে আসছে। আজ সারাদিন মেঘ, বৃষ্টি, বাদল, অন্ধকার, শীত। আমাদের দেশে যখন বৃষ্টি হয়, তখন মুষলধারে বৃষ্টির শব্দ, মেঘ, বজ্র, বিদ্যুৎ, ঝড়—তাতে একটা কেমন উল্লাসের ভাব আছে। এখানে তা নয়, এখানে টিপটিপ করে সেই একঘেয়ে বৃষ্টি ক্রমাগতই অতিনিঃশব্দ পদসঞ্চারে চলছে তো চলছেই। আমাদের দেশে স্তরে স্তরে মেঘ করে। এখানে আকাশ সমতল, মনে হয় না মেঘ করেছে, মনে হয় কোনও কারণে আকাশের রঙটা ঘুলিয়ে গিয়েছে, সমস্তটা জড়িয়ে স্থাবর-জঙ্গমের একটা অবসন্ন মুখশ্রী। তারই মধ্যে আমার হঠাৎ মনে পড়ছে প্রণয়কুঞ্জে হঠাৎ দেখা সেই শ্যামাঙ্গিনীর মুখ!’
ঠাকুরপো, এ-চিঠির শেষে তুমি ‘পুনশ্চ’ দিয়ে লিখেছ—’নতুন বউঠান, ইটালি থেকে তোমাকে চিঠি লিখতে পারিনি। মনে পড়ে গেল, ইটালির মেয়েদের বড় সুন্দর দেখতে। অনেকটা আমাদের দেশের মেয়ের ভাব আছে। সুন্দর রং কালো কালো চুল, কালো ভুরু, ভালো চোখ, আর মুখের গড়ন চমৎকার। ‘ আমাকে তোমার অন্য নারীসঙ্গের কথা জানিয়ে আঘাত করতে তোমার ভালোলাগত ঠাকুরপো—এই ছিল তোমার আধুনিকতার নিষ্ঠুরতা। আমি যত এইভাবে আঘাত পেয়েছি, ততই হয়তো তোমাকে আরও তীব্রভাবে ভালোবেসেছি। তুমি যে বিহারীলাল নও, তোমার প্রেমে যে খোঁচা আছে, তির্যক আঘাত হানতে পারো তুমি—এসব যত জেনেছি। ততই যেন আরও জানবার জন্য মন আমার তৃষ্ণার্ত হয়েছিল। বিহারীলালকে আসন উপহার দেওয়ার পর তিনি লিখলেন—তোমার আসনখানি /আদরে আদরে আনি / রেখেছি যতন করে। চিরদিন রাখিব।
ঠাকুরপো তোমার কাছ থেকে ছোট-ছোট আঘাত পেতে-পেতে বিহারীলালের গদগদ সমর্পণের ভাবটিকে আমার ক্রমে সেকেলে লাগছিল—এ-কথা অকপটে স্বীকার করছি। কিন্তু তুমি যখন। সুদূর বিলেত থেকে বিদেশিনীদের রূপের কথা লিখতে, তখন আমার বুকের মধ্যে ঈর্ষার যন্ত্রণাও অনুভব করেছি। কী যে ভয় করত আমার—তুমি যদি আর আমার না থাকো! কী নিয়ে থাকব। আমি ঠাকুরপো!
ঠাকুরপো, একলা থাকতে-থাকতে আর নানারকম গঞ্জনা শুনতে-শুনতে এক সময়ে ভাবতে শুরু করেছিলুম, এই রকমই মেয়েমানুষের জীবন। তোমার নতুনদাদা মাঝে মধ্যে আমায় ঘোড়ায়। চড়িয়ে গড়ের মাঠে নিয়ে যেতেন বটে, তবে সেটা ছিল তাঁর বড়মানুষি খেয়াল। আমার মনের খবর, আমার গভীর কিছু চাহিদার খবর তিনি রাখতেন বলে মনে হয় না।
তুমি যেই বিলেত থেকে ফিরে এলে ঠাকুরপো অন্য সুর বাজল আমার জীবনে। কেন যে তুমি আমার জীবনে এইভাবে উজানের মতো এসেছিলে। তুমি ওইভাবে মহাসমারোহে আমার জীবনে না এলে তোমার চলে যাওয়াটা আমাকে এতখানি নিঃস্ব করে দিত না।
একটি দুপুরবেলার কথা আমি ভুলব না কোনওদিন। সেদিন আমার খুব জ্বর ছিল। তুমি পাশে বসে পাখার হাওয়া করছ আমাকে। আমি জ্বরে আচ্ছন্ন হয়ে আছি।
তুমি হঠাৎ বললে, ‘এতদিন আমার জীবনে নারী বলে যেন কিছুই ছিল না। নারী বলে যে কিছু আছে তা তো এতদিন বুঝতেই পারিনি। সে একরকম মন্দ ছিল না। নতুনবউঠান, যেই তুমি। এলে আমার জীবনে, তোমার ভিতর দিয়েই যেন নারীকে চিনলুম। ‘ তোমার কথা শুনে আমার চোখে জল এল ঠাকুরপো। আমি গরিব ঘরের মেয়ে। খুব যে আদর যত্নের মধ্যে বড় হয়েছি, তা তোনয়। ভালোবাসার জন্য বড্ড তেষ্টা ছিল মনের মধ্যে। বিয়ের পরে তোমাদের বাড়ির বউ হয়ে এসে একমাত্র তোমার কাছেই জীবনে প্রথম আদরযত্ন, ভালোবাসা পেয়েছিলাম। তোমাকে তাই প্রথম থেকেই আমি কাছে টেনে নিয়েছিলাম। তার মধ্যে কোনও মিথ্যা ছিল না।
তোমার কথার উত্তরে সেদিন বলেছিলাম—
‘আমার ভিতর দিয়ে তুমি যে নারীকে চিনতে পেরেছ, সে-নারী তো কেবল আমি। আমাকে জানলে মেয়েজাতটাকেই জানা হয়ে গেল, এমন ঠুনকো কথা তোমাকে মানায় না ঠাকুরপো। তাছাড়া, আমি অতি সাধারণ এক গৃহবধূ—তার মধ্যে নারীজাতির কতটুকুই বা প্রকাশ পেতে পারে?’
তুমি উত্তরে বলেছিলে, ‘নতুনবউঠান, তুমি জানো, মাকে আমি বেশি পাইনি। তোমার মতো আমার ছোটবেলাটাও কেটেছে আদরযত্নের অভাবে। মায়ের ঝোঁক ছিল জ্যোতিদাদা আর। বড়দার ওপরেই। আমি ছিলুম তাঁর কালো ছেলে। মা যেদিন আমাদের জীবন থেকে চিরদিনের জন্যে বিদায় নিলেন, তুমি এলে আমার জীবনের সবটুকু জুড়ে। ‘
তোমার কথা শুনে আমি বলেছিলাম, ‘ঠাকুরপো, তোমাকে আমি আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলাম সব দিক থেকে তুমি যাকে বলেছ নাগপাশের বন্ধন। ধীরে ধীরে আমার শরীর-মন তোমার ডাকে সাড়া দিল। কিন্তু তা বলে তুমি যদি বলো আমার ভিতরেই তুমি জানতে পেরেছ সমগ্র নারীজাতিকে, সেই ভার আমি বহন করতে পারব না ঠাকুরপো। আমি অতি সাধারণ মেয়ে।