‘প্রাণের নতুনবউঠান,
সেদিন ফ্যান্সি-বল-এ অর্থাৎ ছদ্মবেশী নাচে গিয়েছিলাম। কত মেয়ে-পুরুষ নানা রকম সেজেগুজে সেখানে নাচতে গিয়েছিল। প্রকাণ্ড ঘর, গ্যাসের আলোয় আলোকাকীর্ণ, চারদিকে ব্যান্ড বাজছে, ছ-সাত-শো সুন্দরী, সুপুরষ। ঘরে ন স্থানং তিলধারয়েৎ। চাঁদের হাট তো তাকেই বলে। এক-একটা ঘরে দলে-দলে স্ত্রী-পুরুষ হাত ধরাধরি করে ঘুরে-ঘুরে নাচ আরম্ভ করেছে, যেন জোড়া-জোড়া পাগলের মতো। এমন ঘেঁষাঘেঁষি যে কে কার ঘাড়ে পড়ে ঠিক নেই। একটা ঘরে শ্যাম্পেনের কুরুক্ষেত্র পড়ে গিয়েছে, মদ্যমাংসের ছড়াছড়ি, সেখানে লোকারণ্য। এক একটা মেয়ের নাচের বিরাম নেই, দু-তিন ঘণ্টা ধরে ক্রমাগত তার পা চলছে। মন অধিকার। করবার যত প্রকার গোলাগুলি আছে বিবিরা তা অকাতরে নির্দয়ভাবে বর্ষণ করছেন। কিন্তু ভয়। কোরো না নতুনবউঠান, আমার মতো পাষাণ হৃদয়ে তার একটু আঁচড়ও পড়েনি। একজন দিশি মেয়ে সেজে গিয়েছিলেন—তাঁকে ভিড়ের মধ্যেও আলাদা করে দেখতে পেলাম। একটা শাড়ি, একটা কাঁচুলি তাঁর প্রধান সজ্জা, তার ওপরে একটা চাদর পরেছিলেন, তাতে ইংরিজি কাপড়ের চেয়ে তাঁকে ঢের ভালো দেখাচ্ছিল। এই ছদ্মবেশী নাচের পার্টিতে আমি সেজে ছিলাম বাংলার জমিদার। জরি দেওয়া মখমলের কাপড়, জরি দেওয়া মখমলের পাগড়ি, ইত্যাদি। এই পর্যন্ত বেশ ছিল। কিন্তু জনকতক ব্যক্তি আমাকে জোর করে দাড়িগোঁফ পরালেন। আর দু-একজন মহিলা আমাকে বললেন, দাড়ি-গোঁফে বেশ মানিয়েছে আমাকে, ভারী ভালো দেখাচ্ছে। কিন্তু নতুনবউঠান, যে-সকল সুন্দরীদের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে এখানে, তাঁরা কেউই দাড়ি গোঁফধারী আমাকে চিনতে না পারায় আমি কাছে যেতেই তাঁরা সরে পড়তে লাগলেন! শেষ পর্যন্ত দাড়ি-গোঁফ উৎপাটন করে আমাকে নিজরূপে প্রকাশিত হতেই হল নতুনবউঠান। ‘
ঠাকুরপো, তোমার এ-চিঠি পেয়ে আমি মজা পেয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু বুকের মধ্যে হু-হু করেও উঠেছিল। আমি স্পষ্ট যে দেখতে পাচ্ছিলাম, ওই শাড়ি আর কাঁচুলি পরা বিদেশিনী সুন্দরীর সঙ্গে তুমি নাচ্ছ তোমার সঙ্গে নাচতে-নাচতে খুলে গিয়েছে তার পোশাকের ওপরে ঢাকনার মতো চাদরটি—তুমি আর সে পাগলের মতো শুধু নাচ্ছ, তোমরা এত ঘেষাঘেঁষি যে দুজনকে কিছুতেই আলাদা করতে পারছি না আমি। একলা ঘরে এ-চিঠি বুকে জড়িয়ে ধরে কত কেঁদেছি ঠাকুরপো। ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করেছে তোমার কাছে–চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়েছে, ফিরে এসো ঠাকুরপো!
বিলেত থেকে তুমি যেসব চিঠি লিখেছ আমাকে, তাদের অনেকটাই জুড়ে আছে তোমার মুক্ত নারীসঙ্গের আনন্দ—যেমন নারীর সঙ্গ তুমি এদেশে চাইলেও পাবে না, লিখেছ তাদেরই কথা। এই সুন্দরী বিদেশিনীদের ভিড়ে আমি কোথায় হারিয়ে গেছি ঠাকুরপো! এসব চিঠি-পড়তে পড়তে খালি মনে হত, তোমার জীবন থেকে একেবারে মুছে গিয়েছি আমি। আমি সহ্য করতে পারতাম না। আর সেইজন্যই বেশি করে চাইতাম তোমার সঙ্গক্রমশই বুঝতে পারছিলাম। তোমার কোনও বিকল্প নেই আমার জীবনে। মনে মনে ভাবতাম, একবার ফিরে এসো, তোমাকে সবদিক থেকে জড়িয়ে-জড়িয়ে আমি গ্রাস করে ফেলব—কোনও মুক্তির পথ থাকবে না তোমার।
কেন ঠাকুরপো, কেন কেন তুমি লিখেছিলে এ-রকম চিঠি? তোমার আধুনিক মন আমাকে কষ্ট দিয়ে দিয়ে পাগল করে তোমার প্রেমে পতঙ্গের মতো আটকে ফেলতে চেয়েছিল? তুমি লিখেছিলে লন্ডন থেকে–
‘গত মঙ্গলবারে একজনের বাড়িতে একটি নাচের নিমন্ত্রণে গিয়েছিলাম। আমি পরেছিলাম নাচপার্টির উপযুক্ত পোশাক। আমার শার্টটি ছিল একেবারে নিষ্কলঙ্ক ধবধবে সাদা। তার ওপরে। প্রায় সমস্ত বুকখোলা এক বনাতের ওয়েস্টকোট। ওয়েস্টকোটের মধ্যে সাদা শার্টের সমুখ। দিকটা বেরিয়ে। গলায় সাদা নেকটাই। হাতে ছিল একজোড়া সাদা দস্তানা। নতুনবউঠান, দস্তানা বিলেতের শীতের জন্য নয়। যে-মহিলাদের হাতে হাত দিয়ে নাচব, আমার খালি হাত লেগে তাদের হাত যাতে ময়লা না হয়, সেই জন্য দস্তানা। রাত সাড়ে ন’টায় গিয়ে পৌঁছেছিলাম নাচ পার্টিতে—ঘরের মধ্যে রমণীদের রূপের আলো গ্যাসের আলোকে ম্রিয়মাণ করে দিয়েছে!
নতুনবউঠান, সেই নাচঘরে ঢুকে মনে হল, রূপের উৎসব পড়ে গিয়েছে। ঘরের ভিতরে প্রবেশ করা মাত্রই চোখে বাঁধা লেগে গেল। ঘরের একপাশে পিয়ানো, বেহালা, বাঁশি বাজছে, ঘরের চারিধারে কৌচ চৌকি সাজানো, ইতস্তত দেয়ালের আয়নার ওপর গ্যাসের আলো ও রূপের প্রতিবিম্ব পড়ে ঝকমক করছে।
নতুনবউঠান, একটা কথা তোমায় না বলে পারছি না। এ-আমার স্বীকারোক্তি। নাচবার ঘরের মেঝেটি ছিল কাঠের। তার ওপর কার্পেট পর্যন্ত পাতা নেই। সে কাঠের মেজে এমন পালিশকরা যে পা পিছলে যায়। তবে তোমার এই দেওরটি ক্রমেই আবিষ্কার করেছে যে, ঘর যত পিছল হয়, ততই নাচবার উপযুক্ত হয়। কেননা একমাত্র পিছল ঘরেই আমার অপটু নাচের গতি সহজ হয়, পা কোনও বাঁধা পায় না, আপনা-আপনি পিছলে যার কাছে যেতে চাই তার কাছেই চলে আসে।
নতুনবউঠান, সাহেবমেমেদের রোম্যান্টিক কল্পনার তারিফ না করে পারছিনে। ঘরের চারিদিকে যে-বারান্দাগুলি আছে তাই গাছপালা দিয়ে ঢেকে কৌচ চৌকি রেখে বানানো হয়েছে প্রণয়ীদের। জন্য মনোরম কুঞ্জ। এর বেশি আর বলছি না, বাকিটুকু তুমি কল্পনা করে নিতে পারো। নাচতে নাচতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে ওই মনোরম প্রেমকুঞ্জই বিশ্রামের উপযুক্ত জায়গা—বিশেষ করে বয়েস যাদের অল্প, তাদের জন্যই এই প্রেমকুঞ্জের বিশেষ আয়োজন।