সেই সময়ে আমি একটা আসন বুনছিলাম। কার্পেটের আসন। যখনই একলা লাগত, কাজ নেই হাতে, সময় কাটাবার উপায় ছিল ওই আসনটির কাছে ফিরে যাওয়া। মনে মনে চাইতাম, এই। আসনবোনার কাজটি যেন কোনওদিন না শেষ হয়। তোমার নতুনদাদা ঘরে আসেন-ান, দেখেন। খাটের এক কোণে বসে আমি আসন বুনি, কোনওদিন জিগ্যেস পর্যন্ত করেননি কার জন্যে এই আসন। আসনবোনার কাজটির মধ্যেও যে মিশে যেতে পারে মন, ভালোবাসা—এসব কথা তাঁর মনে উদয় হয়নি হয়তো কখনই।
সেদিন বিহারীলালের কথা শোনবার পরেই কী যে একটা কাণ্ড ঘটে গেল মনের মধ্যে! যে মানুষটির মধ্যে তৈরি হয়েছে আমার করস্পর্শের জন্যে এমন আকুল আকাঙ্ক্ষা, তাঁকে এমন কিছু একটা উপহার দিতে আমার মন চাইল, যার মধ্যে চিরদিন থেকে যাবে আমার মন, আমার ভালোবাসা, আমার হাতের ছোঁয়া। দৌড়ে আমার ঘরে এসে ওই আসনটির কোণে বুনতে শুরু করলাম বিহারীলালের নাম। ক’দিন পরে আসনটি তুলে দিলাম আমার প্রিয় কবির হাতে সেইদিন আমি প্রথম ‘অসতী’ হলাম ঠাকুরপো, কারণ ওই আসনটিই ছিল বিরাহীলালের প্রতি আমার প্রেমপত্র।
আসনটি উনি দু’হাতে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন আমার পানে। আমি লজ্জায় ওঁর চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। আমার মধ্যে যে একেবারেই কোনও অন্যায়বোধ ছিল না, তাও নয় ঠাকুরপো। কিন্তু সেই পাপবোধ, অন্যায়বোধ ছাপিয়ে উঠেছিল আমার এত বছর ধরে চেপে রাখা অভিমান—ছাপিয়ে উঠেছিল আমার ভালোবাসা। সেদিন থেকে আমার প্রতি বিহারীলালের ব্যবহারও গেল বদলে। তিনি চোখ তুলে তাকাতেই পারতেন না আমার দিকে। ক্রমে আমাদের বাড়িতে আসাও কমিয়ে দিলেন। তবে, যখনই লিখতেন। কোনও নতুন কবিতা, চলে আসতেন আমাদের সাহিত্যসভায়। অনেকেই থাকতেন সেই মজলিসে। অবশ্যই থাকতেন তোমার নতুনদাদা। থাকতেন মেজবউঠাকরুণ। কিন্তু আমার মনে হত, হয়তো আরও অনেকেরই মনে হয়েছে একই কথা—বিহারীলাল শুধু আমারই জন্যে লেখেন তাঁর প্রেমের কবিতা। শুধু আমাকেই শোনান। সভায় উপস্থিত বাকিদের কথা তাঁর বোধহয় মনেই থাকে না।
তুমি তখন বিলেতে। ক্রমে আমার মধ্যে তৈরি হল এক গভীর অভাববোধ—কীসের অভাব, সবই তো আছে, তবু অভাববোধ, বিষণ্ণতা, মনকেমন। ঠাকুরপো, মনকেমন তোমার জন্যে। তোমার চিঠি আসে বিলেত থেকে। আসে তোমার কবিতা। আমার মন, আমি বুঝতে পারি, ধীরে-ধীরে সরে যাচ্ছে বিহারীলালের জগত থেকে তোমার জগতে। কেন এমন হচ্ছে, তাও বুঝতে পারি
আমি। এক সময়ে তোমাকে বলতাম, ঠাকুরপো, তুমি কোনওদিন বিহারীলালের মতন লিখতে পারবে না। শুনে তুমি যত না দুঃখ পেতে তার চেয়ে অনেক বেশি বেড়ে যেত আরও ভালো লেখার ঝোঁক—বিহারীলালের মতো লেখা নয়। তাঁর প্রভাবমুক্ত অন্য রকম, আরও ভালো লেখা। আমি তখুনি বুঝতে পেরেছিলাম, তোমার প্রতিভা জাতেগোত্রে আলাদা। কিন্তু জানতে দিইনি। তোমাকে—জানতে দিয়ে পাছে তোমার মাথা খেয়ে বসি।
তোমার বিলেত থেকে আসা চিঠিগুলিই আমাকে প্রথম বুঝিয়ে দিল, বিহারীলালের জগতের অনেক দূরে, অনেক বাইরে পা ফেলেছ তুমি বুঝতে পারলাম ঠাকুরপো, তুমি অনেক দূরের যাত্রী, তোমার এ-যাত্রা থামার নয়, যতই তুমি এগোবে, ততই পিছিয়ে যাবে তোমার সামনে। দিগন্তরেখা। বুঝতে পারলাম, তুমি অনন্তের পথিক। ঠাকুরপো, জোড়াসাঁকোর বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে এক বিপন্ন বন্দিনী আমি। তবু পাড়ি দিতে চেয়েছিলাম তোমার সঙ্গে। হতে চেয়েছিলাম তোমার সহযাত্রিণী। কখন আসবে বিদেশ থেকে তোমার চিঠি, শত বাঁধা ডিঙিয়ে অবশেষে পৌঁছবে আমার হাতে–তোমার প্রবাসের পত্রের জন্যে সারাক্ষণ অপেক্ষা করত মন।
তোমার কোনও কোনও চিঠি যত ভালো লাগত, ততটাই–না, তার চেয়েও বেশি কষ্টও দিত আমাকে। আজ মনে হচ্ছে, তুমি আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্যেও লিখতে। বিহারীলাল কখনও। আমাকে এইভাবে কষ্ট দিতে পারতেন না। তিনি আমাকে ছাড়া আর কোনও নারীর কথা ভেবেছেন বলেই তো মনে হয় না আমার। প্রেমের ব্যাপারে তিনি নিতান্ত সেকেলে। তুমি। ঠাকুরপো ততটাই আধুনিক। ভালোবাসার মেয়েটিকে তোমার জীবনে অন্য নারীসঙ্গের কথা বলে তার মধ্যে ঈর্ষা জাগিয়ে তুমি আধুনিকতার আনন্দ পাও—এ স্বভাব তোমার, একনিষ্ঠ। বিহারীলালের নয়। তোমার এই স্বভাব আমাকে দুঃখ দেয়। আবার এই স্বভাবই আমাকে তোমার দিকে অমোঘ টানে টেনেছে—যত তুমি অন্য নারীর কথা আমাকে জানিয়েছ ইশারায়, ইঙ্গিতে, ততই মনে হয়েছে তোমাকে সবদিক থেকে নাগপাশের মতো জড়িয়ে ধরে সম্পূর্ণ গ্রাস করে। ফেলি। আজ সেই নাগপাশ থেকে তোমাকে চিরমুক্ত করে দিয়ে যাব। আমাকে তুমি ভুলে যাও ঠাকুরপো।
ঠাকুরপো, ইংল্যান্ড থেকে আমাকে লেখা তোমার একটি চিঠি আমার চোখের সামনে রয়েছে। একটির পর একটি এই রকম চিঠি আমার যন্ত্রণা, আমার একাকিত্ব বাড়িয়ে দিল একদিকে। অন্যদিকে আমার হৃদয়ে আর কারও জন্যে এতটুকু জায়গা রাখল না। সবটুকু জিতে নিল তোমার চিঠি—তুমিই হয়ে দাঁড়ালে আমার জীবনের একমাত্র অধীশ্বর। কবি বিহারীলালকে এতদিনে বড্ড সেকেলে লাগতে লাগল আমার, দেখলাম তোমার সঙ্গে তাঁর কোনও তুলনাই চলে না, তিনি আস্তে-আস্তে নিঃশব্দে ঝরে গেলেন আমার জীবন থেকে।
আবার দ্যাখো, খেই হারিয়ে চোখের সামনে প্রবাস থেকে লেখার তোমার ওই চিঠিটা থেকে কতদূরে সরে এলাম—সেই চিঠিতে তুমি লিখেছ: