আদরের বউঠান, একথা তোমাকে কতবার বলেছি, আবার বলছি, বৈষ্ণব পদাবলীর অভিসার ভাবনায় বৃষ্টি, জল, রতিসুখ, শৃঙ্গার সব অঙ্গাঙ্গি জড়িয়ে আছে। তাদের পৃথক করা যায় না। আমি অন্তত পারি না। তোমার বুকে যে হারটি দুলছে, সেটিও রাধার হারের মতো—’তরলিত’। সেখান থেকে রাধাই ঝরে পড়ছে বিন্দু বিন্দু। জয়দেব লিখছেন, রাধার হার থেকে ঝরে পড়ে তার রতিশ্রমের ঘাম :
শ্রমজলকণভরসুভগশরীরা।
পরিপতিতোরশিরতিরণধীরা।
০৬. চিরবিদায়
নতুনবউঠান, একদিন দুপুরে তোমার ওই ভিজে হারটি আমার গলায় পরিয়ে দিয়েছিলে। আজ তোমাকে বলি—তোমার মধ্যে আমি পেয়েছি বৈষ্ণবকাব্যের রাধাকে। সেই তারল্য। সেই চাপল্য। সেই হাসি। সেই চোখ।
একদিন চণ্ডীদাসের রাধা বৃষ্টির মধ্যে কৃষ্ণকে বলল, কানাই, তোমার এই নৌকাটিকে যমুনার জলে ডুবিয়ে দাও। আর পাছে যমুনার জলে আমি ভিজে যাই, তুমি আমাকে কোলে করে যমুনা পার হও।
নতুনবউঠান, রাধা বলতে আমি যা কিছু ভাবতে পারি, তুমি তার সবটুকু। নৌকা ডুবিয়ে আমি কবে পাগলের মতো নেমে পড়েছি যমুনার জলে—তোমারই জন্যে নতুনবউঠান!’
ঠাকুরপো, তুমি একদিন এ-চিঠি লিখেছিলে আমাকে! আর আজ তোমার কবিতায় আমার। আদরের, আমার শরীরের, তোমার-আমার কোনও নির্জন স্মৃতির চিহ্নমাত্র নেই। আজ আমি পুরাতন। আজ আমাকে জায়গা ছেড়ে দিতে হবে তোমার জীবনে নতুন খেলার জন্যে। আজ আমার সামনে শুধুই অন্ধকার। তবে তাই হোক ঠাকুরপো, জ্বলুক-পুড়ুক আমার শরীর। তারই সঙ্গে জ্বলে-পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক তোমার এই চিঠিটিও।
আদরের ঠাকুরপো, আবার আমার জীবনের শেষ প্রহরের ছন্নছাড়া মন পথ হারিয়ে চলে এল। নতুন এক মনকেমনে। তখন তুমি ছিলে অন্য মানুষ। আমার প্রাণের মানুষ তো। শুধু আমারই ছিলে তখন। তোমার দ্বিতীয়বার বিলেত যাওয়ার কথা উঠতেই একা থাকার যন্ত্রণার ভয়ে আমি চেষ্টা করলাম আত্মহত্যার। মরলাম না। কিন্তু তৈরি হল আমার নতুন বদনাম। নতুন লজ্জা। আমার পক্ষে ঠাকুরবাড়ির পরিবেশ অসহনীয় হয়ে উঠল। আমি তোমার নতুনদাদাকে নিয়ে চলে এলাম চন্দননগরে। সেখানে ভাড়া করা হল নীল ব্যবসায়ী মোরান সাহেবের বিরাট কুঠিবাড়ি। সেখানেই উঠলাম আমরা দু’জনে বুঝলাম দু’জনেও একা হওয়া যায়। তোমার নতুনদাদা থাকেন তাঁর নিজের জগতে। আর আমি তোমার জন্যে সারাক্ষণ দুঃসহ মনকেমন নিয়ে, আমার নিজস্ব বেদনা ও অপমানবোধ নিয়ে, নির্বাসিত থাকলাম আমার জগতে। তোমার জাহাজ চলল তোমাকে নিয়ে মাদ্রাজে, সেখান থেকে শুরু হবে তোমার দ্বিতীয়বার বিলেতযাত্রা।
কিন্তু বিলেত গেলে না তুমি! মাদ্রাজে জাহাজ থেকে নেমে চলে এলে আমার কাছে। ঠাকুরপো, তুমি এলে, আমার শরীর-মনে জোয়ার এল। মনে হল, পৃথিবীটা কী সুন্দর। আমার হৃদয়বাড়ি ফিরল নির্বাসন থেকে।
কিন্তু কেন তুমি বিলেত গেলে না ঠাকুরপো? পাছে ঠাকুরবাড়ির মহিলামহলের বিষাক্ত পরিবেশে একাকিত্বের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আমি আবার আত্মহত্যার চেষ্টা করি—তাই তো? তুমি ফিরে এলে আমার আশ্রয় হয়ে! কিন্তু বাঁচাতে কি পারলে আমাকে? আমার প্রেমই আমার নিয়তি—তুমি বাঁচাবে কীভাবে!
ঠাকুরপো, যদি বলি বিলেতের পথ থেকে তোমার এই ফিরে আসার মধ্যেই নিহিত ছিল আমার। মরণের বীজসহ্য করতে পারবে? না না, আমি চলে যাওয়ার পরে কোনওরকম অপরাধবোধে ভুগে কষ্ট পেয় না তুমি। কষ্ট দিও না তোমার একরত্তি নতুন বউটিকে। এ-আমার ভাগ্য তোমার তো কিছু করার নেই। তোমার ভালোবাসাই তো তোমাকে টেনে এনেছিল আমার কাছে। বাকিটুকু তো তোমার-আমার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল না।
ঠাকুরপো, তোমার অনেক আগে আমার প্রেমে পড়লেন কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী। তিনি তোমার নতুনদাদার বন্ধু। তাঁর সূত্রেই বিহারীলাল আসেন এ-বাড়িতে। বন্ধুত্ব হল আমার সঙ্গেও। আমি ছিলাম তাঁর গুণমুগ্ধ পাঠিকা, শ্রোতা। তিনি শুধু তাঁর নতুন লেখা আমাকে শোনাতেই ভালোবাসতেন না, ভালোবাসতেন আমার হাতের রান্না খেতে।
একদিন আমাকে বললেন, ‘তোমার হাতের স্পর্শ আছে বলেই তোমার হাতের রান্না এত ভালো।
কথাটা আমার মধ্যে ঠাকুরপো তৈরি করল নতুন তরঙ্গ। এমন কথা এ-বাড়িতে কারও মুখে আগে কখনও শুনিনি। তোমার নতুনদাদার জন্যে তো আমি কত নতুন-নতুন রান্না করি। তিনি সেই। রান্না খেয়ে কোনওদিন আমাকে আমার আঙুলের স্পর্শের উল্লেখ করেননি। এই দেখো, বিহারীলালের কথা বলতে গিয়ে একটু বাড়াবাড়িই করে ফেললাম আমি তোমার কথাটা ভুলেই গেলাম। ঠাকুরপো, তুমি তো কতবার আমাকে বলেছ, আমি যেদিন সামান্য লঙ্কা দিয়ে তোমার। জন্যে মেখে দিই পানতাভাত সেদিন আর কথা থাকে না! সে তো আমার অঙ্গুলিস্পর্শের গৌরব ঠাকুরপো, তাই না?
একদিন বিকেলবেলা বিহারীলাল এলেন যেন আমার সঙ্গেই কথা বলতে। তখনও তোমার নতুনদাদা কাছাড়িবাড়িতে, নীচের তলায়। আমি ছিলাম নির্জন।
বিহারীলাল বললেন, ‘তুমিই আমার সারদামঙ্গল’ কাব্যের সরস্বতী। তিনটি প্রেরণার স্রোত এসে মিশেছে আমার সারদামঙ্গলে। তিনটি স্রোতই হল বিরহের স্রোত মৈত্রীবিরহ, প্রীতিবিরহ, সরস্বতীবিরহ। তুমিই বসে আছ এই তিন বিরহস্রোতের কেন্দ্রে। ‘ ঠাকুরপো, বিহারীলালের কথাটা যে খুব ভালো বুঝতে পারলাম, তা নয়। কিন্তু বুকের মধ্যে কেমন একটা করতে লাগল। দেখলাম, বিহারীলালের চোখ আবেগে ছলছল করছে। বুঝলাম আমাকে ভালোবেসে উনি কষ্ট পাচ্ছেন। ওঁর জন্যে কষ্ট হল। আবার ভালোও লাগল ঠাকুরপো। আমাকে ভালোবেসে আমার বিরহে কেউ কষ্ট পেতে পারেন! বিহারীলালের কথায় কেন যেন আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম।