আমার যে একটা শরীর আছে ঠাকুরপো মাঝেমাঝে সত্যি ভুলে যাই—এই শরীরটা এবার পুড়বে, শরীরের সব চিহ্ন, সমস্ত ইচ্ছে আগুনে ছাই হবে। আজ শরীরটাকে ছেড়ে যাওয়ার আগে আরও একবার পড়তে ইচ্ছে করছে চিঠিটা। এ-চিঠির অক্ষরে-অক্ষরে আমার দেহ তোমার চোখে হয়ে উঠেছে উৎসব—সারা চিঠিটা যেন আমার রূপের মধ্যে যে-আর্দ্রতার দেখা পেয়েছিলে তুমি, তারই উদযাপন। তোমার-আমার তৈরি নন্দনকাননের মতো আজ আমার দেহটাও শীর্ণ, জীর্ণ,। শুকনো। নন্দনকাননে শুধুই এখন শুকনো পাতার ভিড়, একটিও ফুল নেই। আমার শরীরের কোনওকালে যে ফুল ফুটেছিল, তার চিহ্নমাত্র নেই। অথচ তুমিই একদিন আমাকে ডেকেছিলে ‘সরোবরময়ী’ বলে। বলেছিলে আমি শ্রীরাধার মতো আর্দ্র মেয়ে। আমার দেহ তোমার চোখে বৃষ্টি ভেজা বাগানের মতো। এই তো তুমি লিখেছ :
‘আমার অনেক আদরের নতুনবউঠান, আজ বড্ড গরম পড়েছে। আকাশে মেঘ নেই। ভুবনে বৃষ্টি নেই। তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে। হঠাৎ দেখলাম তোমাকে, বিকেলবেলা সদ্য গা-ধোয়া তুমি, নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে নন্দনকাননের দোলায় গিয়ে বসলে, তোমার গ্রীবাটি এখনও ভিজে ভিজে। তোমার গ্রীবায় জলভেজা চুলগুলি চিকচিক করে লোভ দেখাল আমাকে। তোমার। সদ্যস্নাত শরীরের ভিজেভাবটি ছড়িয়ে পড়েছে তোমার শাড়ির শরীরেও। আমার মনে এল চণ্ডীদাসের কাব্যে ‘গলিতবসন’ শব্দটি। আর তখুনি মনে হল, নতুনবউঠান, তুমিই যেন শ্রীরাধা। তোমার আঁচলটির প্রতি উদাসীন। এক আর্দ্র আলস্যের মধ্যে যেন ডুবে আছ তুমি। শ্রীরাধার ভিজে বসনকে চণ্ডীদাস বর্ণনা করেছেন একটি শব্দে—’রসনাহীন’। অর্থাৎ মেখলাবন্ধনমুক্ত। তোমার আঁচলটিও তেমনি যেন ‘রসনাহীন’। দক্ষিণের বারান্দার কোণ থেকে আমি তাকিয়েছিলাম তোমার দিকে। চণ্ডীদাস যেমন দেখেছেন রাধাকে, ঠিক তেমনি দেখলাম আমি তোমাকে। ’লাবণ্য জল তোর সিহাল কুন্তল/বদন কমল শোভে অলক ভষল। ‘ তোমার দিকে। তাকিয়েও আমার মনে হল, যদিও আকাশে মেঘ নেই, ভুবন জলহীন রুক্ষ, তবু তোমার শরীর যেন সরোবর, তোমার মুখটি সেই শরীরসরোবরে পদ্মের মতো বিরাজমান। তোমার মুখের ওপর উড়ু উড়ু চুল খেলা করছে, যেন ভ্রমর। নতুনবউঠান, তোমার হাসি আর তোমার চোখ, আমি কোনওদিন ভুলতে পারব না। তোমাকে একটু আগেই তো দেখলাম নন্দনকানন্দের দোলনায়, আকাশ পানে তাকিয়ে। চণ্ডীদাসের মতো আমারও মনে হল, সরোবর-বউঠানের দুটি চোখে দুটি নীলকমল ভাসছে। আর বিকেলবেলার আলোয় তোমার ওই সদ্যধৌত দুটি গাল কেমন লাগল আমার জানো? চণ্ডীদাসকে দিয়ে বলিয়ে নিই আমার মনের কথা—নতুনবউঠান, তোমার দুটি গাল নেশা ধরানো ভিজেভিজে মহুয়া ফুল। সুন্দরী নতুনবউঠান, তুমি সরোবরময়ী।
এবার শোনো, খুব মন দিয়ে শোনো, কেন তোমাকে বললাম সরোবরময়ী। রাধার ঠোঁট দুটিকে বৈষ্ণবকাব্যে বলা হয়েছে, যেন পদ্মের ভেজা পাপড়ি। আমিও যদিও তোমার ঠোঁট দুটিকে তাই বলি—নতুনবউঠান, খুব রাগ করবে আমার ওপর? আর যদি বলি, তোমার হাসি যেন সিক্ত পদ্ম। তোমাকে বরং বলি বৈষ্ণপদাবলীর রাধা কতদূর ভিজে মেয়ে–রাধার অধর যেন সদ্যফোটা ভিজে বাঁধুলি ফুল–ফুটিল বন্দুলী ফুল বেকত অধর। রাধার বাহু যেন সিক্ত মৃণাল। রাধার করতল যেন আর্দ্র রক্তপদ্ম। তোমার করতল আমার করতলে যখনই ধরা দিয়েছে, আমারও মনে হয়েছে একই কথা। রাধার অপরূপ স্তন দুটি যেন শরীর সরোবরে সাঁতারু হাঁস। রাধার ভিজে কোমরের তিনটি ভাঁজ, ত্রিবলি, যেন সরোবর-ঘাটের তিনটি সিক্ত সোপান। রাধার নধর নিতম্ব যেন সরোবর ঘাটের পিছল শিলা। নতুনবউঠান, এই ভেজা রাধার জন্যেই শ্রীকৃষ্ণ বিরহে জীর্ণ। পুরুষ যুগে-যুগে চেয়েছে এমন নারী, তাকে না পাওয়ার জন্যে কষ্টও পেয়েছে। বৈষ্ণবকাব্যে রাধার নামের নারীটি সদা ‘তরল’। নতুনবউঠান, সংস্কৃত ভাষায় ‘তরল’ শব্দটি ‘চপল’ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। রাধার শরীর কি শুধুই ‘তরল’। সেই তরলতা রাধার শরীর ও স্বভাবের চাপল্যকেও যে বোঝাচ্ছে!
রাধার গভীর নাভিতে দুলছে নাগকেশর ফুল। সেই অনন্যার জঙ্ঘায় ফুটছে স্বর্ণকেতকী। তার তেলতেলে ভিজে কাপড় যেন তিসির তৈরি। কী আশ্চর্য তুলনাযার গভীর প্রসারী ব্যঞ্জনা এই বার্তাটুকু পৌঁছে দেয় যে, জল আর তেল যেমন এক হয় না, তেমনি একসঙ্গে থাকে না রাধার। শরীর ও বসন। রাধার ‘তরল’ অর্থাৎ চপল ও আর্দ্র শরীর থেকে ক্রমাগত খসে যাচ্ছে আবরণ।
নতুনবউঠান, আমি জানি তুমি বলবে, বৈষ্ণব কবিরা গভীর রাত্রে ঝড়ের সময়ে রাধিকার অকাতর অভিসার সম্বন্ধে অনেক ভালো মিষ্টি কবিতা লিখেছেন, কিন্তু একটা কথা ভাবেননি, এরকম ঝড়ে তিনি কৃষ্ণের কাছে কী মূর্তি নিয়ে উপস্থিত হতেন। তাঁর চুলগুলোর অবস্থা যে কীরকম হত! কেশবিন্যাসেরই কীরকম দশা? ধুলোতে লিপ্ত হয়ে, তার ওপর বৃষ্টির জলে কাদা জমিয়ে, কুঞ্জবনে কীরকম অপরূপ মূর্তি করে গিয়েই দাঁড়াতেন!
আদরের বউঠান, তোমার যুক্তির এবং বক্তব্যের সারবত্তায় আমি এতটুকু সন্দেহ প্রকাশ করছি না। কিন্তু বৈষ্ণব পদাবলীর রাধা তো প্রেমের নারীরূপ। সেই চিরন্তন রমণী শ্রাবণের অন্ধকার রাত্রে কদম্ববনের ছায়া দিয়ে যমুনার তীরপথে প্রেমের আকর্ষণে ঝরবৃষ্টির মাঝে আত্মবিহ্বল হয়ে স্বপ্নগতার মতো চলেছেন, পাছে শোনা যায় বলে পায়ের নূপুর খুলে রেখেছেন, পাছে দেখা যায়। বলে রাতের অন্ধকারে পরেছেন নীলাম্বরী কাপড়, কিন্তু পাছে ভিজে যান বলে ছাতা নেননি। পাছে পড়ে যান বলে বাতি আনা আবশ্যক বোধ করেননি। নতুনবউঠান, প্রেম তো এই রকমই।