‘নতুনবউঠান, তুমি শুনতে ভালোবাস প্রতাপাদিত্যের গল্প। আজকাল প্রায়ই দুপুরবেলা তোমার একলা ঘরে তোমার পাশে শুয়ে শুয়ে পড়ে শোনাই প্রতাপচন্দ্র ঘোষের বঙ্গাধিপ পরাজয়ের কাহিনি। তোমাকে জানাই, তোমাকেই গল্প শোনাতে শোনাতে আর তোমার হাত পাখার বাতাস খেতে খেতে আমার মনের মধ্যে নিঃশব্দে রচিত হল, ‘বউঠাকুরানির হাট’। ঠাকুরপো, যাঁরা তোমার ‘বউঠাকুরানির হাট’ পড়ে মুগ্ধ হবেন, বা ভাববেন কত না কথা, তাঁরা কি জানবেন। কোনওদিন এই কথা যে দুপুরবেলা আমার পাশে শুয়ে-শুয়ে আমার হাতপাখার বাতাস খেতে খেতে তুমি প্রথম ভেবেছিলে এই উপন্যাসের গল্প? তুমি যা আমাকে বলেছ তা আমারই থাক, আমার সঙ্গে পুড়ে যাক তোমার ভালোবাসার এই স্বীকারোক্তি।
অনেক আদরের ঠাকুরপো, তোমার বেশিরভাগই চিঠিই বেশ ছোট। আমার মন খারাপ হয়ে যেত চিঠি খুব ছোট হলে। কিন্তু ক্রমে বুঝতে পারলাম, দু-একটি কথায় তুমি এত কথা বলতে পারো যে তোমার বেশি লেখার দরকার হয় না। তা ছাড়া, ছোট চিঠি লুকিয়ে রাখাও সহজ। হয়তো সেকথা ভেবেও তুমি চিঠির বহর ছোট রাখতে। তবে চিঠি তোমার যতই ছোট হোক ঠাকুরপো, আমার। কাছে তোমার কোনও চিঠি পড়াই শেষ হয়নি—আজও। কতবার পড়েছি এইসব চিঠি। তবু। বারবার পড়তে ইচ্ছে হয়। যেমন এই চিঠিটা, লিখেছ, ‘নতুনবউঠান, আবার চলে যেতে হবে তোমাকে ছেড়ে? আবার বিচ্ছেদ? আবার তোমার-আমার মনকেমনের কষ্ট? নতুনবউঠান, আজ সন্ধেবেলায় যখন আমরা দু’জনে দাঁড়ালাম দক্ষিণের ছাদের নিঃসঙ্গ কিনারে, মনে হল ধূসর দিনের দিকে তাকিয়ে, যেন দাঁড়িয়ে আছি সাগরের তীরে তোমারই পাশে। অনেক দূরে, সাগরের ওপারে, মেঘাচ্ছন্ন অন্ধকার এক দেশ, যেখানে যেতে হবে তোমাকে ছেড়ে। আমার মন হঠাৎ কথা বলে উঠল কবিতায় দিবস ফুরাবে যবে, সে দেশে যাইতে হবে। এপারে ফেলিয়া যাব আমার তপন শশী। নতুনবউঠান, তুমি আমার তপন শশী, তুমিই আমার জীবনের ধ্রুবতারা, তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও কোনওদিন যাব না। যেতে পারব না। ‘ ঠাকুরপো, এসব কথা যখন লিখেছিলে তখন তুমিও কি জানতে অক্ষরে-অক্ষরে বাসা বেঁধে আছে কত বড় মিথ্যে!
আমার প্রাণের রবি, কত কথা মনের মধ্যে জেগে উঠেই হারিয়ে যাচ্ছে, তলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে চিরকালের মতো কোনওদিন আর ফিরে আসবে না তারা। মনে পড়ছে, সেদিন ছিল ৫ই জুলাই। আমার জন্মদিন। আবার বিয়ের দিনও। তোমার জ্যোতিদাদাকে বলেছিলাম, যেন একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরেন। তিনি সেদিন বাড়িই ফিরলেন না। জানি না তিনি সারারাত কোথায়। ছিলেন। মেজবউঠাকরুণের কাছে না থিয়েটারের মজলিসে। অনেক রাত হয়ে গেল। বুকের মধ্যে কী যে আগুন জ্বলছিল সেই রাতেই আমি চিতায় পুড়েছি ঠাকুরপো। আমার মরণ হয়েছে সেই রাতেই। এমন সময়ে তুমি ঢুকলে ঘরে। আমি বললাম, এত রাতে কোথা থেকে? তুমি বললে, আজ তোমার জন্মদিন। সবাই ভুলেছে। আমি ভুলিনি নতুনবউঠান। আমার তখন সব জ্বলছে। ঝলসে গেছে সব শরীর মন। ঠাকুরপো, তুমি কাছে এসে দাঁড়ালে। আমার বুকের আঁচল জ্বলছে, জ্বলছে-পুড়ছে আমার চোখ, যে চোখ তুমি এত ভালোবাস, আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না। অন্ধকার ঘরে জ্বলছি আর পুড়ে ছাই হচ্ছি—তুমি জড়িয়ে ধরলে আমার জ্বলন্ত শরীরটাকে।
ঠাকুরপো, আমি জানতাম না আমার শরীরে এখনও এত আগুন ছিল। তুমিও কি ভাবতে পেরেছিলে? তুমি হয়তো না জেনেই তোমার বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেছিলে সেই আগুন। আমার আগুন ঠাকুরপো ছড়িয়ে পড়ল তোমার সারা শরীরে। তুমিও গেলে ঝলসে। আমার আদরে ছিল সেদিন শুকনো কান্না। আমার শরীরে চিতার শিখা। তুমি আঁকড়ে ধরেছিলে সেই অন্ধকার দহন।
ঠাকুরপো, অমন আদর এ-জীবনে আর পাইনি। তুমি আদর করছ আমাকে, আর আমার জ্বলন্ত ইচ্ছে ক্রমাগত বেরিয়ে আসতে চাইছে বহ্নিমান আবরণের যন্ত্রণা থেকে। মনে হল আমার কানের লতিতে হঠাৎ যেন ছোবল মারল আগুনের দংশন, একটিই শব্দ বেরিয়ে এল তখন ঠাকুরপো! কতক্ষণ আমার জ্বলন্ত শরীরটা তুমি আঁকড়ে ছিলে—কতক্ষণ আমার সঙ্গে সে-রাত্রে তুমিও পুড়েছিলে—আমি কিছু জানি না। তোমরা বুকের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙল তখন পুবের আকাশে সবে দেখা দিয়েছে আলো। দেখলাম একাই শুয়ে আছি। আমার বুকের ওপর তুমি রেখে গেছ তোমার দু-লাইনের এই চিঠি :
‘মেঘের দুঃস্বপ্নে মগ্ন দিনের মতন।
কাঁদিয়া কাটিবে কিরে সারাটি যৌবন।’
কয়েকদিনের মধ্যে আমি আত্মহত্যার চেষ্টা করলাম। সেই আমার প্রথম চেষ্টা। কিন্তু মরলাম না। তুমি লিখলে, ‘জ্যোর্তিময় তীর হতে আঁধার সাগরে/ঝাঁপায়ে পড়িল এক তারা/একেবারে উন্মাদের পারা!’
আমার ঠাকুরপো, ক্রমে বেলা বাড়ছে। আজ খিদেতেষ্টা সব ভুলেছি। প্রায় দেখতে পাচ্ছি পথের শেষ। এত যন্ত্রণার অবসান আর খুব দূরে নয়। তবু এখনই মনে হচ্ছে, যদি তুমি আমারই থাকতে ঠাকুরপো, যেমন ছিলে তুমি, তাহলে এখনও আমি থাকতে পারতাম পৃথিবীতে, আমার সব বেদনা ও অপমান মেনে নিয়েও। তুমি থাকলে জীবন এমন নিঃস্ব হতে যেত না।
এই দেখো! পেয়েছি সেই চিঠিটা। এ-চিঠিটা বেশদীর্ঘ। চিঠিটা যখন প্রথম পড়ি, সত্যি কথা বলছি, ভালো লাগেনি আমার। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়েছিল। আর তোমাকেই যেন দূরে সরিয়ে দিয়েছিল মন! কিন্তু তোমার এই চিঠিটা কোনওদিন আমার কাছে ফুরিয়ে গেল না। বারবার আমার নিঃসঙ্গ মুহূর্তে ফিরে-ফিরে এসেছে এই চিঠি আমার জীবনে! যতবার পড়েছি। চিঠিটা, ততবারই খুঁজে পেয়েছি নতুন অর্থ প্রতিটি শব্দ নতুনভাবে আদর করেছে আমাকে।