সেদিনের পরে আর কখনও চিঠি লেখোনি আমাকে। আমি রোজ ভাবতাম, আজ তোমার চিঠি পাব নিশ্চয়। কিন্তু আর কোনওদিন একটিও চিঠি এল না। হঠাৎ যেন তোমার ভালোবাসা মরুপথে হারাল ধারা। কিংবা বেঁকে গেল অন্য কারও জন্যে অন্য কোনও পথে।
আজ তোমার-আমার সব চিঠি ছড়িয়ে দিয়েছি আমার লেখার টেবিলে। তাদের আমি মুক্তি দিয়ে গেলাম ঠাকুরপো। আমার চিতার আগুনে আমারই সঙ্গে তারাও শেষ হোক—এই আমার শেষ বাসনা।
ঠাকুরপো, একটি চিঠিতে তুমি লিখেছ—চিঠিটা লিখেছিলে বিলেত থেকে ফিরেই লিখেছ তুমি, ‘আমার নতুন বউঠান, দু-বছর পরে বিলেত থেকে ফিরে এসে দেখলেম, যে উনিশবছরের মেয়েটিকে ফেলে গিয়েছিলেম আর যে একুশ বছরের মেয়ের কাছে ফিরে এলেম, তারা যেন এক মেয়ে নয়। সত্যি কথা বলবে বউঠান—তুমি কি আমার ফিরে আসার পথ চেয়ে বসে থাকনি?
ফিরে এসে ক্রমশ বুঝতে পারছি ঠাকুরবাড়িতে একুশ বছরের তুমি কত একা! তোমাকে যে। আমাদের কর্মচারী শ্যাম গাঙ্গুলির মেয়ে বলে আমাদের বাড়ির মহিলামহলে কত গঞ্জনা শুনতে হয়, সে-কথা বুঝতে পেরেছি আমি। তোমাকে কথা শুনতে হয় তোমার গায়ের রং কালো বলেও। অথচ তোমার ওই লাবণ্যময় শ্যামলবর্ণ আমার কত আদরের তা তো তুমি জানো। তুমি নিঃসন্তান বলেও তোমাকে খোঁটা দিতে সবাই সুযোগ খোঁজে। নতুনবউঠান, যতই দেখছি এ-বাড়িতে। তোমার প্রত্যহের কষ্ট, ততই যেন আরও বেশি ভালোবাসছি তোমাকে। তোমার প্রতি আমার এই ভালোবাসা ঠাকুরবাড়ির হৃদয়হীনতার বিরুদ্ধে আমার প্রতিবাদও বলতে পারো।
এইসব প্রতিকূলতা সত্বেও আমি বিলেত থেকে ফিরে আসতেই আমাদের দু’জনের জীবনে যেন। উজান এসেছে। আমার উনিশ আর তোমার একুশ ভেসে যাচ্ছে সেই উজানে,—বন্ধনহীনগ্রন্থিতে আমরা বাঁধা পড়েছি দু’জন দু’জনের সঙ্গে, কোনও বাধা নেই কোথাও। এই যে যৌবনের আরম্ভেই বাংলাদেশে ফিরে এসেছি—এ ঘটনা ঘটেছে তোমার-আমার ভাগ্যের টানে। অন্যরকম কিছুতেই হতে পারত না। ফিরে এসেই তোমাকে পেলাম—অন্য তুমি। পেয়েছি সেই ছাদ, সেই চাঁদ, সেই নিজের মনের বিজন স্বপ্ন, সেই ধীরে-ধীরে ক্রমে-ক্রমে চারদিক থেকে ঘনিয়ে ওঠা, প্রসারিত সহস্র বন্ধন! নতুনবউঠান—এ তোমার বন্ধন। মুক্তি চাইনে আমি। কোনওদিন চাইব না। আমি বিলেত থেকে ফিরে অব্দি তোমার নাগপাশে জড়িত বেষ্টিত হয়ে চুপ করে বসে আছি। আমার খুব ভালো লাগছে নতুনবউঠান।
ঠাকুরপো, এই তো আর একটা চিঠি। সারা চিঠিতে শুধু দুষ্টুমি। সত্যিই তুমি এত ভালোবাসতে আমাকে? লিখেছ ‘নতুনবউঠান, এত ছলচাতুরি, প্রেমের এতরকমের খেলা তুমি শিখলে কোথায় বলোতো? সেদিন সবাই আমরা বসেছি খেতে। জ্যোতিদাদা, আমি, সেজদাদা। মেজবউঠাকরুণ আর তুমি করছ পরিবেশন। কী যে সুন্দর দেখাচ্ছে তোমার লালপাড় ডুরে শাড়িতে। তুমি আমার কাছাকাছি এসেই তুললে তোমার কনক কাঁকনের তরঙ্গ। কত ছলভরে যে বাজাতে পারো তুমি তোমার সোনার চুড়ির গোছা। কে কি বুঝল জানি না, আমি বুঝলাম, এই কঙ্কনঝংকার আমার। জন্যে। আর তখুনি আমার মনে হল, তুমি শ্রীরাধা। মুহূর্তে আমার চোখের সামনে বদলে গেল দৃশ্য। দেখলাম তুমি যমুনার জলে কনককলসে জল ভরছ আর ইচ্ছে করে আমারই জন্যে কত ছলভরে বাজাচ্ছ তোমার কাঁকনগুচ্ছ। আমার মন যেন যমুনার জল নতুনবউঠান। সেই জলে নেমেছ তুমি। তোমার দিকে তাকিয়ে, তোমার চুড়ির শব্দ শুনে, আমার মন বলে উঠল, কেন বাজাও কাঁকন কত ছলভরে। তুমি যেন আমার মনের কথা বুঝলে। আমার পাতে পরিবেশন শেষ করে তুমি এগিয়ে গেলে বটে মেজদাদার দিকে, চকিত নয়নে আমার দিকে তাকানো তোমার। ফুরল না। আমার মন যেন জল। তুমি পায়ে-পায়ে এগিয়ে যাও। অথচ আমার মনে হয় তুমি সাঁতার কাটছ আমার মনের স্রোতে। জলে ঢেউ তুলে তুলে খেলা করছ। এক সময়ে খাওয়াদাওয়া শেষ হল। আমি ফিরে এলাম আমার ঘরে। তবু সেই যে ঢেউ তুললে তুমি আমার মনে, সেই সব। হাসিভরা ঢেউ কলস্বরে কানাকানি করতেই থাকল মনের মধ্যে। জানলা দিয়ে দেখলাম আকাশে ক্রমে জমছে মেঘমালা। মনে হল, সেই মেঘ বাগানকিনারে তোমারই মুখপানে তাকিয়ে। নতুনবউঠান, হঠাৎ তোমার উদ্দেশ্যে মনের মধ্যে ভেসে উঠল দুটি সহজ সরল লাইন—
প্রকাশ করি কিসের ছলে মনের কথা
তোমার রঙিন পাতায় লিখব প্রাণের কোন বারতা।
০৫. নতুনবউঠান
নতুনবউঠান, এ-দুটি লাইন মনে এসে টেনে আনল আরও দুটি লাইন। লিখে রাখলাম আমার খাতায় :
বন্ধু, তুমি বুঝবে কি মোর সহজ বলা—নাই যে আমার ছলাকলা, কইতে গেলে রইবে কি তার সরলতা। ‘
প্রাণের ঠাকুরপো, তোমার একটি চিঠি মাত্র কয়েক লাইনের। কিন্তু কী যে লজ্জা পেয়েছিলাম চিঠিটা পড়ে। আবার ভালো লেগেছিল—আমার বুকের মধ্যে সারাবেলা রেখে দিয়েছিলাম চিঠিটা। এই সেই চিঠি—আমার সঙ্গে চিতায় পুড়বে। তুমি লিখেছ, ‘তব ওষ্ঠ দশনদংশনে টুটে যাক পূর্ণফলগুলি। ‘ তুমি যখন দুষ্টুমি করো ঠাকুরপো, তোমার সঙ্গে পেরে উঠবে কে? তুমি যে ভাষার জাদুকর—এই একটা লাইনে তুমি কি না বললে! আজ জীবনের শেষ দিনে আরও। একবার বুকের মধ্যে রেখে দিতে ইচ্ছে করছে তোমার এই একটি লাইন—এত মায়া কী করে ছেড়ে যাই ঠাকুরপো?
রবি, আর একটি চিঠিতে তুমি লিখেছ এমন কয়েকটি লাইন যা হয়তো বাঁচিয়ে রাখাই উচিত–ভবিষ্যতে যার মূল্য হতে পারে অপরিসীম। তবু সেটাকেও পুড়িয়ে দিও কারণ সেই চিঠিতেও যে প্রকাশ পেয়েছে তোমার অবৈধ প্রেম: