হঠাৎ মনে পড়ছে তোমার মা, আমার শাশুড়িঠাকরুণকে। ভিতরের পাঁচিল ঘেরা ছাদে তিনি বসেছেন সন্ধেবেলায় মাদুর পেতে। তাঁর সঙ্গিনীরা বসেছেন তাঁকে চারদিকে ঘিরে। হালকা হাসিতামাশা আর পরচর্চা। আমার শাশুড়িঠাকরুণের সঙ্গিনীদের কেউ-কেউ ছিলেন পরের বাড়ির খবর সরবরাহে বিশেষ পারদর্শিনী। এঁদের মধ্যে একজনকে ডাকা হত আচার্জিনী নামে। তিনি। জনৈকব্রজ আচার্জির বোন। তিনি যেসব খবর জোগাড় করে আনতেন তার বোধহয় অধিকাংশই শোনা খবর। বা স্রেফ বানানো। কিন্তু শাশুড়িঠাকরুণ বিশেষ পছন্দ করতেন তাঁকেই তাঁর রসালো গল্পের জন্যে। আমার অবিশ্যি প্রবেশাধিকার ছিল না ছাদের সেই বৈঠকে। কিন্তু তুমি এক একদিন ঢুকে পড়তে তোমার বিদ্যেবুদ্ধি জাহির করতে ওই মহিলামহলে।
ঠাকুরপো, তখন তুমি-আমি একই সঙ্গে লেখাপড়া শিখছি। তোমার নতুন শেখা বিদ্যে জাহির করার একটা সহজ জায়গা তোমার মায়ের সঙ্গিনীদের ওই বিকেলবেলার আড্ডাতেই। তোমার টাটকা পুঁথিপড়া বিদ্যে নিয়ে প্রায়ই ছুটে যেতে সেখানে। কখনও এই তথ্য পরিবেশন করে। মায়ের সঙ্গিনীদের তাক লাগিয়ে দিতে যে সূর্য পৃথিবী থেকে ন’কোটি মাইল দূরে। আবার কখনও ঋজুপাঠ দ্বিতীয় ভাগ থেকে আউড়ে যেতে বাল্মিকী-রামায়ণের টুকরো। তোমার এই বিদ্যেবুদ্ধি জাহিরের ব্যাপারটায় আমি খুব মজা পেতাম।
বাড়ির ভিতরের ছাদটাকে দখল করে নিয়েছিল ঠাকুরবাড়ির মহিলামহল। এই ছাদটা ছিল ঠাকুরবাড়ির ভাঁড়ার ঘরের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। মেয়েরা দুপুরবেলা ছাদে যেত অনেক কাজ একসঙ্গে করতে। রোদে শুকোতো এলো চুল। জারক নেবুও জারিয়ে নিত ওই রোদে। পিতলের গামলা ভরা কলাইবাটা নিয়ে তারা বড়ি দিত ছাদেই।
ওই মেয়েদের ছাদেই তোমার সঙ্গে আমার প্রথম বন্ধুত্ব ঠাকুরপো। তখন তোমার বয়েস সাত। আমি তোমার চেয়ে দু’বছরের বড়। কাঁচা আম ফালি করে কেটে আমসি শুকোনো হত। তোমার নজর ছিল সেই দিকে। তুমি ঘুরঘুর করতে রোদ খাওয়া সরষের তেলে মজে-ওঠা ইঁচড়ের। আচারের পাত্রগুলির পাশেও। ধরা পড়বার সম্ভাবনা দেখলেই ভান করতে, যেন তোমার ছাদে আসার প্রধান উদ্দেশ্য কাক তাড়িয়ে আমাকে সাহায্য করা।
ঠাকুরপো, আজ তুমি সবই ভুলেছ, ভুলতে পারলাম না আমি। বাড়িতে তুমিই ছিলে আমার একমাত্র দেওর। আমাদের বন্ধুত্বের শুরু আমসত্বের হাত ধরে নিশ্চয় মনে পড়ে না তোমার। তোমাকে নিযুক্ত করেছিলাম আমি আমার আমসত্বের পাহারাদার। তখন থেকেই তোমাকে মনে মনে খুব ভালোবেসেছিলুম আমি। তোমাকে চাইতাম আমার সব খুচরো কাজের সাথি করে। তুমিও ছিলে এক পা বাড়িয়ে। ইস্কুলে যেতে তুমি একেবারে চাইতে না। কারণটা যে ছিল আমার সঙ্গে তোমার বন্ধুত্বের টান, সে কি আমি বুঝতাম না ভেবেছ। তুমি ইস্কুল ছুটি হলেই সোজা চলে আসতে আমার ঘরে সেখানে আমিই তোমাকে শিখিয়েছিলুম জাঁতি দিয়ে সুপুরি কাটতে। খুব সরু করে সুপুরি কাটতে পারতে তুমি। আমি যেই তোমার সুপুরি কাটার প্রশংসা করতাম, অমনি আরও তাড়াতাড়ি আরও সরু করে সুপুরি কাটতে তুমি। আমি মনে মনে বেশ মজা পেতাম।
ঠাকুরপো, এ-বাড়ির বউ হয়ে আসার পর তুমিই আমাকে দিলে মুক্তির প্রথম স্বাদ, চেনালে আমার প্রথম ছুটির দেশ। আমাকে ভোরবেলা একদিন নিয়ে গেলে বাইরের ছাদে।
বলেছিলে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে অনেক ভোরবেলা যেন আমি তোমার সঙ্গে দেখা করি তেতলার বাবামশায়ের ঘরের সামনে। তাই করলাম আমি। চুপিচুপি গেলাম সেখানে।
দেখলাম, তুমি সেখানে দাঁড়িয়ে। বললে, আর দেরি করলে দেখতে পেতে না। আমি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছি।
আমি তো অবাক। কাকে দেখব এত সকালবেলা! তুমি আমাকে হাত ধরে ছুটিয়ে নিয়ে গেলে বাইরের ছাদে। চিলেকোঠার আড়ালে দাঁড়িয়ে দূর থেকে দেখলাম, সূর্য উঠছে।
আমার জীবনে সেই প্রথম সূর্যোদয়। তোমার হাত ধরে।
আমার জীবনে সেই সূর্য আজ নিভে যাবে। আর মাত্র কয়েকটা ঘণ্টা বাকি। তুমি কোথায় ঠাকুরপো?
ঠাকুরপো, মনে আছে তোমার, কারণে-অকারণে কত চিঠি লিখতে আমাকে। একই বাড়িতে একই ছাদের তলায় আমি, তবু লিখেছ চিঠি! যে কথা মুখে বলতে না, বলতে চিঠিতে। আমিও যে লিখিনি তোমাকে, তা নয়। তবে তোমার মতন কি লিখতে পারি আমি? তোমার দুঃখ, তোমাকে আমি চিঠির উত্তরে সব সময়ে লিখতাম না বলে। তা ছাড়া, আমার চিঠি হত ছোট সেটাও ছিল তোমার দুঃখের কারণ। আজ তোমার সেই দুঃখ হয়তো কিছুটা মিটিয়ে দিয়ে গেলাম।
আমার রবি, তুমি যত চিঠি লিখেছ আমাকে, আমি তোমাকে লিখেছি যত চিঠি, সব ছিল আমার কাছে, আমার আলমারির গোপন ড্রয়ারে। যেখানে কারও হাত পৌঁছবার কোনও সম্ভাবনাই ছিল না। তোমার বিয়ের ক’দিন আগে তুমি এলে আমার ঘরে। নির্জন দুপুরে, যেমন আসতে তুমি, আমার সঙ্গে কত সময় কাটিয়েছ তুমি আলস্যের দুপুরবেলায়। সেদিন তোমার চোখ দেখেই বুঝলাম, আজকের দুপুর অন্যরকম হতে চলেছে। গভীর বেদনাবোধ আর হতাশা ফুটে উঠেছিল তোমার চোখে।
তুমি এসেই আমার হাতে ধরিয়ে দিলে হাতির দাঁতের কাজ করা একটি কাঠের বাক্স। বললে, নতুনবউঠান, এই বাক্সে আছে আমাকে লেখা তোমার সব চিঠি। আজ থেকে তুমিই এদের আশ্রয় দিও। আমার মনে হল, কান্না চেপে কথাগুলি বললে আমাকে। তারপর দ্রুত বেরিয়ে গেলে আমার ঘর থেকে।