তখন তোমার-আমার জীবন ছিল অন্যরকম। তখন তোমার ঘর ছিল শুধু তোমারই ঘর। সেই ঘরে আমার গতিবিধি ছিল অবাধ। কোনও কুণ্ঠার পরদা ছিল না মাঝখানে।
তোমার মল্লার আমাকে ডাকল। যেমন করে গাইছিল আকাশ, ঠিক তেমনি করেই গাইলে তুমি। পাশের ঘর থেকে একবার এলেম তোমার দুয়ার পর্যন্ত।
আবার ফিরে গেলাম। আবার একবার বাইরে এসে দাঁড়ালাম। তারপর তোমার মগ্ন মল্লারের টানে ভিতরে না এসে পারলাম না। ধীরে ধীরে ভিতরে এসে বসলাম তোমার পাশটিতে। তোমার মনে আছে ঠাকুরপো? না কি সব ভুলে গেছ?
হাতে ছিল আমার সেলাইয়ের কাজ। আমি মাথা নীচু করে তোমার পাশে বসে সেলাই করতে লাগলুম। তোমার আকাশের মতো গান, তার সমস্ত মেঘ-বৃষ্টি-ঝড়-বিদ্যুৎ নিয়ে, আমার সমস্ত শরীরের ওপর ছড়িয়ে দিল আদর। এমন আদর তোমার কাছ থেকে আমি কোনওদিন পাইনি।
বৃষ্টি ধরে এল। তোমার গান থামল। আমি আমার সেলাই বন্ধ করে জানলার বাইরে ঝাপসা গাছগুলোর দিকে চেয়ে রইলুম। মনে হল, আমার জীবনের মতোই ঝাপসা ওরা।
তারপর একটিও কথা না বলে আমি আমার ঘরে ফিরে এলাম চুল বাঁধতে। ঠাকুরপো, সেদিন আমি গা ধুইনি। পাছে ধুয়ে যায় তোমার আদর। যেমন ধুয়ে যায় নাগকেশরের সোনালি রেণু বৃষ্টিতে।
ঠাকুরপো, আমি তোমাকে চিনি, জানি, কাছে পেয়েছি, ভালোবেসেছি সতেরো বছর ধরে।
কেমন করে তোমাকে ছেড়ে থাকব ঠাকুরপো? তুমি বিলেত চলে যাবে, তোমাকে ছেড়ে থাকতে হবে, কেমন করে সেই যন্ত্রণা ঠাকুরবাড়ির বন্ধুহীন পরিবেশে আমি সহ্য করব—সে-কথা ভেবে আমি চেষ্টা করেছিলাম আত্মহত্যার। কিন্তু মরতে পারিনি। তোমারই জন্যে হয়তো পারিনি ঠাকুরপো।
এবার পারব তো? মৃত্যুর পরে তোমাকে ছেড়ে থাকব কেমন করে ঠাকুরপো?
তোমার বিয়ের কথা যখন সব পাকা হয়ে গেল, যখন আর ফেরবার পথ নেই তোমার, যখন আমি জানলাম, তোমাকে হারিয়েছি আমি চিরদিনের জন্যে, আমার রবি এখন অন্যের, আমার সঙ্গে এলে দাবা খেলতে।
আমার সঙ্গে দাবার খেলায় জিততে পারতে না কখনও। ভাব দেখাতে যেন ইচ্ছে করেই হেরেছ।
আমি বললাম, ‘আমি হেরে গেছি রবি। আর আমি খেলব না। ‘
তুমি বললে, ‘তুমিই তো জিতে গেলে বউঠান। আমার জীবনটাই হয়ে যাবে ওলোটপালোট। নতুন বউঠান, তুমি তবু একলা থাকতে পারবে এত বছরের তোমার-আমার কত আসাযাওয়ার, কত দেখাদেখির, কত বলাবলির, তারই আশেপাশে কত স্বপ্ন, কত অনুমান, কত ইশারার স্মৃতি নিয়ে। আমার জীবন থেকে একাকিত্বের সেই গৌরবটুকুও হারিয়ে যাবে। ইচ্ছে করলেও আমি। তোমার চোখের শুকতারার আলো, তোমার চুলের চামেলি ফুলের গন্ধ, তোমার হাসির ইশারার স্মৃতির সঙ্গে একলা হতে পারব না। নতুন সম্পর্কের চাহিদার ভিড়ে আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে। ‘
ঠাকুরপো তোমার কথা শুনে আমার চোখে জল এল। কিছুতেই লুকিয়ে রাখতে পারলাম না। বেদনা।
তুমি আমার ঘরে খাটে এসে বসে রইলে অনেকক্ষণ। তারপর হঠাৎ আমার হাত দুটি তোমার বুকে চেপে ধরে বললে, ‘কতভাবে তুমি আমার নাম ধরে ডেকেছ বউঠান! ওই নামে, ওই ডাকে যে-মানুষ এতকাল সাড়া দিয়েছে সে তো শুধু বিধাতার রচনা নয়। নতুনবউঠান, সে-মানুষ যে তোমারও রচনা। ‘
আমি কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারলাম না। ভেঙে পড়লাম কান্নায় তোমার বুকের ওপর।
তোমার কথাগুলি মিশে গেল তোমার গভীর আলিঙ্গনে। আমার মনে আছে সেই কথা, ‘নতুনবউঠান, কখনও আদরে, কখনও অনাদরে, কখনও কাজে, কখনও অকাজে, কখনও সবার সামনে, কখনও একলা আড়ালে, কেবল একটি মানুষের মনে মনে জানা দিয়ে গড়া এই আমি। আর যে-মানুষটি এত বছর ধরে আমাকে গড়ল, সে তুমি বউঠান, সে তুমি। ‘
ঠাকুরপো, সেদিন তোমার কথার উত্তরে কোনও কথা বলতে পারিনি আমি। বেদনার আচ্ছন্নতায় ডুবে গিয়েছিলাম। আজ যাওয়ার বেলায় তোমাকে বলি, ‘এই যে তোমাদের সতেরো বছরের জীবন, কত মনে পড়া, কত টাটকা গন্ধ, কত ক্লান্ত সুর, কত বৃষ্টির মতো আদর,—এসব থাকবে কোথায়? তুমি তো আর তাদের ডেকে নিয়ে গিয়ে ঘরে রাখতে পারবে না। ঠাকুরপো, আমার সঙ্গে তাদেরও বিদায় জানিও। ওরা উড়ে চলে যাক বাতাসে। ওদের আর খুঁজতে বেরিও না।
রবি মনে আছে তোমার, তুমি পানতাভাত খেতে ভালোবাসতে? চিংড়িমাছের চচ্চড়ির সঙ্গে পানতাভাত! ইস্কুল থেকে ফিরেই খুব খিদে পেত তোমার। তখন খেতে পানতাভাত। আর খেতে দিতে হত আমাকে। না হলে তোমার মুখে রুচত না।
বিলেত থেকে ফিরেই তুমি খেতে চাইলে পানতাভাত আর চিংড়ি চচ্চড়ি। আমি তো অবাক। বললাম, ‘ঠাকুরপো, কত ভালো ভালো রান্না খেয়ে এসেছ, মেমসাহেবদের হাতের রান্না, এখন। কি আমার তৈরি পানতাভাত আর চিংড়ির চচ্চড়ি তোমার ভালো লাগবে?’
তুমি হেসে বললে, ‘নতুনবউঠান, সারা ভুবন ভ্রমিয়া যে-স্বাদ পাইনি সে তোমার মেখে দেওয়া পানতাভাতের স্বাদ। ঠিক যেমন দিতে ছেলেবেলায় তেমনি দাও তো, চিংড়িমাছের চচ্চড়ির সঙ্গে পানতাভাত অল্প একটু লঙ্কার আভাস দিয়ে। ওই আভাসটুকু যেন হয় তোমার হাতের। অমন আর কেউ পারে না নতুনবউঠান। ‘
কত কথা যে মনে পড়ছে ঠাকুরপো! এলোমেলোভাবে। তা হোক। মনটা আলগা করে দিয়েছি। জীর্ণ মনটা নিজেকে হালকা করুক। ভার বহন করতে আর যে পারছে না। তুমি যাকে বলতে, নীচের তলার চোরাকোনা দেয়ালের প্যাকবাক্স’, যেখানে আমাদের মতো গরিব আত্মীয়স্বজন আটক পড়েছে, সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে যখন ঠাকুরবাড়ির বউ হয়ে এলাম তোমাদের বাড়ির অন্দরমহলে, দেখলাম এ-বাড়ির চালচলন একেবারে অন্যরকম। ক্রমশ সেই ঠাকুরবাড়িও বদলে গেল। এখন এখানে আর নিশ্বাস নেওয়া যায় না। অন্তত আমি পারি না। আমার কাছে। জোড়াসাঁকোর বাড়ি যেন এক প্রেতপুরী—এখানে আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি, তাই অনেক সময় বুঝতে পারি না। এ-বাড়ির সব আনন্দ, সমারোহ, নিভে গেছে, অন্তত আমার জন্যে। গান বাজনার যে-আসর এ-বাড়িতে বসত, কত নাটক, কবিতা, গল্পের আসর, সব উধাও। শুনেছি মেজবউঠাকরুণের বাড়িতে এখন সাহিত্যসভা হয়। যত আলো সেখানে। আমার ঘরে সামান্য বাতিটুকুই আমার সম্বল। মেজবউঠাকরুণের মজলিসে আমায় ডাকে না।