ব্যক্তিগতভাবে আমার ধারণা ১৮৭২ থেকে ১৯১১–প্রায় চল্লিশ বছর কালের এই দীর্ঘ লড়াই সবটা এক অকারণ পণ্ডশ্রমে পর্যবসিত হয়েছে। ১৯১১ থেকে ২০১১ শত বছর অতিক্রান্ত। চণ্ডাল নাম বিমুক্ত হয়ে, নমঃশূদ্র নামে হিন্দুধর্মের চতুবর্ণ ব্যবস্থার মধ্যে অনুপ্রবেশ পেয়ে, তারা কী ফিরে পেয়েছে তাদের হৃত সামাজিক সম্মান? পাচ্ছে কী বর্ণপ্রভুদের কাছ থেকে সেই মানবিক ব্যবহার?
আজ নমঃশূদ্র সমাজের মানুষের মধ্যে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার রাজনেতা কবি শিল্পী সাহিত্যিক কম নেই। ডাক্তার তার রোগীর কাছে শিক্ষকতার ছাত্রছাত্রীর কাছে কবি সাহিত্যিক তার পাঠক পাঠিকার কাছে রাজনেতা জনতার কাছে সাধারণতঃ যে শ্রদ্ধা সম্মান পাবার অধিকারী সেটুকু তিনি পেশাগত কারণে হয়ত পেয়ে থাকেন, কিন্তু যখন সমপেশার সম প্রতিভার দশ জন একত্রিত হন, স্বাভাবিক কারণেই সেই দশজনের নয় জন হবে উচ্চবর্ণ, কেউ কী বুকে হাত রেখে বলতে পারবেন যে সেই সংখ্যাগরিষ্ট উচ্চবর্ণ মানুষরা নমঃশুদ্র মানুষটির প্রতি সমসম্মান প্রদর্শন করে? মুখ নিচু করে, আড়ালে হাসাহাসি, নিন্দামন্দ, বিদ্রূপ করে না? যে সব বিশিষ্ট নমঃশুদ্র মানুষদের সাথে আমার মেলামেশা এ বিষয়ে তাদের অভিজ্ঞতা বড় তিক্ত, বড় মনোকষ্টের। তাই আজ মনে হয় সেদিনের সেই নাম বদলের আন্দোলন সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে গেছে। নামটির বদল নয়, প্রয়োজন ছিল মানসিকতা পরিবর্তনের আন্দোলন। সেটা হয়নি বলে নমঃশূদ্র সমাজ সামাজিকভাবে আজও রয়ে গেছে সেই অবজ্ঞা অবহেলা অপমানের স্তরে। এক ইঞ্চিও সম্মান বেড়েছে এমন প্রত্যয় হবার মতো কারণ ঘটেনি।
আমার তো এমন মনে হয়, হিন্দু ধর্মের দাসত্ব স্বীকার করে নিয়ে চতুবর্ণ ব্যবস্থার মধ্যে অনুপ্রবেশ করে নমঃশূদ্র সমাজ বর্ণ প্রভুদের গোলাম হয়ে যাবার চেয়ে সেই “পঞ্চমবর্ণ” চণ্ডাল থাকাই অনেক মঙ্গল ছিল। আর যা কিছু হোক সে তো কারও দাস ছিল না। শাস্ত্রে শূদ্রকে দাস বলা হয়েছে। এবং দাসত্ব, তা সে সামাজিক আর্থিক ধর্মীয় যাই হোক তা কোন দিন মনুষত্বের বিকাশের সহায়ক হয় না।
.
আমার মা বাবা দুজনেই ছিলেন সরল সোজা মানুষ। ফলে তারা সঠিক ভাবে বলতে পারেননি আমার জন্ম সাল কোনটি। তবে আমার অনুমান সেটা সম্ভবতঃ ১৯৫০-৫১ সালই হবে। যার মাত্র কয়েক বছর আগে সেই চরম বিপর্যয় ঘটে গেছে যার নাম দেশভাগ। যে দেশভাগের অল্প কিছুদিন আগে সারা দেশকে ঝলসে দিয়ে গেছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়াবহ আগুন। কবীর-নানক-বুদ্ধদেব-শ্রীচৈতন্যের প্রেমবাণী পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল সেই আগুনে, স্বার্থপর রাজনেতাদের ধুর্ত বেওসায়িক কৌশলে। প্রথমে কলকাতা তারপর নোয়াখালি তারপর বিহার, এক দাঙ্গা প্রস্তুত করেছে আর এক দাঙ্গার প্রশস্ত সুতিকাগার। যেখানে জন্ম নিয়েছে শুধু ঘৃণা আর ঘৃণা, হিংসা আর প্রতিহিংসা। যার সর্বশেষ পরিণাম দেশভাগ। দেশভাগের কারণেই লক্ষ লক্ষ প্রাণভয়ে ভীত মানুষ প্রিয় স্বদেশ–“জননী জন্মভূমি” পরিত্যাগ করে পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছে এক অচেনা ভুগোল অজানা ইতিহাস আর অনেক অপমান অত্যাচানা বঞ্চনার অসহ্য এক অধ্যায়ের দিকে। আজও যার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস লেখা হয়নি।
বরিশাল জেলার তুষখালির সন্নিকটে যে গ্রামে আমাদের বসবাস ছিল তখন পর্যন্ত সেখানে কোন ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা হয়নি। আজ হয়নি কিন্তু কাল যে হবে না, এর তখন কোন নিশ্চয়তা ছিলনা। সবাই জানে, দাঙ্গার বীজ সমাজ গর্ভে মজুদ হয়ে আছে। দুর কিংবা নিকট ভবিষ্যতে সে বীজে যে বিস্ফোরণ ঘটবে না এমন ভরসা তখন কে দেবে!
আমার ঠাকুরদারা ছিলেন তিনভাই। বরিশাল জেলার জল মাটির এমন গুণ যে সেই জলমাটির স্পর্শ পাবে সে সব জাড্যতা ঝেড়ে ফেলে ভীষণ রকম সাহসী হয়ে উঠবে। যে কারণেই এই মাটি ইংরেজ শাসকদের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়া বহু বীর বিপ্লবীর জন্ম এবং কর্মভূমি।
আমার ঠাকুরদার ছোট ভাই একদিন সেই “বরিশাইল্যা” সাহসের নৌকায় সওয়ার হয়ে বের হয়ে পড়ে এক দূরদেশ যাত্রায়। সে যাবে উড়িষ্যার কটক জেলায় মোষ কিনে আনতে। খাল বিলের দেশ বরিশালে এখনও রেল লাইন বসেনি, তখন দেশের অন্যত্রও তা সম্পূর্ণ হয়নি। কটকে যেতে হলে পায়ে হেঁটে যাওয়া ছাড়া অন্যভাবে যাবার বিশেষ সুযোগ ছিল না। আর পথে পথে। তখন ছিল চোর ডাকাত ঠগির খুব উৎপাত। ছিল কলেরা ম্যালেরিয়া প্লেগ এই সব মারণ ব্যাধি। তবে এই সব বিঘ্ন বিপদ তুচ্ছ করে সেখানে গিয়ে দুচার খানা মোষ কিনে, এক দু মাস পায়ে হেঁটে ফিরে আসতে পারলে, এখানে যে দামে সেই মোষ বেঁচা যাবে, আর তাতে যা লাভ হবে, ছয় মাস খেটেও অত টাকা চোখে দেখা দুষ্কর।
কিন্তু ভাগ্য মন্দ তার। স্বদেশ স্বভূমি থেকে দশবারো দিনের পথ পার হয়ে এসে হঠাৎ সে আক্রান্ত হয়ে পড়ল মারণ রোগ কলেরায়। সেইকালে গ্রামবাংলায় কলেরা রোগের আর এক নাম ছিল মড়ক। যা একজনের হলে জনে জনে সংক্রামিত হয়ে পড়ত। মড়ক লেগে যেত সারা গ্রামে। উজার হয়ে যেতনগর জনপদ। মাত্র কিছু বছর আগে ভরত কাঠি নামক এক গ্রামে মড়ক লেগেছিল। প্রায় তিনশো পরিবারের সেই গ্রামে নাকি সব মানুষ মরে গিয়েছিল। ঘরে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালাবার মতো একজনও আর অবশিষ্ট ছিল না।