আমাদের মহান হিন্দুধর্মের শাস্ত্রে নির্দেশ আছে, যদি কোন উচ্চবর্ণ ওই হীন নীচ শূদ্র মানুষকে দয়া পরবশ হয়ে কোন খাদ্যদ্রব্য প্রদান করে সে খাদ্য অবশ্যই হতে হবে উচ্ছিষ্ট যা পরিবেশন করতে হবে কোন ভগ্ন পাব এর তাও
যদি কোন শুদ্র ধন সম্পদ সঞ্চয় করে, সেটা হবে শাস্ত্রবিরোধী কাজ। সে ধন সম্পদ কোন ব্রাহ্মণ ছিনিয়ে নিলে, সেটা কোনমতেই অন্যায় কর্ম হবে না।
যদি সে বেদ পাঠ করে তার জিভ কেটে দিতে হবে। যদি সে বেদপাঠ শোনে সিসা গরম করে ঢেলে দিতে হবে তার কানে। যদি কোন শূদ্র সজ্ঞানে কোন ব্রাহ্মণের অঙ্গে পদস্পর্শ ঘটায়, রাজা তাকে মৃত্যুদণ্ড দেবেন। আর যদি কোন ব্রাহ্মণ ক্রোধবশতঃ কোন শূদ্রকে হত্যা করে তিন দিন গায়ত্রী মন্ত্র জপ এবং গঙ্গাস্নানে সব অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত হয়ে যাবে। হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ট মনীষীদের দ্বারা লিখিতশাস্ত্র সমূহে একদল মানুষকে চির পদানত করে রাখার চেষ্টায় এইরকম নীতি নির্দেশিকা শত সহস্র।
যারা শূদ্র জাতির মানুষকে কোন মান মর্যাদা দিতে রাজি ছিল না, যাদের শাস্ত্র শূদ্রকে ঘোষণা করেছে, কাক ও কুকুরের সমগ্রোত্রের জীব বলে, তারা কী করে চাইতে পারে যে তাদের ঘরের কোন মেয়ে ওই “নিকৃষ্ট জাতির” কোন পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হোক। তার বীর্যে গর্ভে সন্তান ধারণ করুক। সেটা যে উচ্চবর্ণের পুরুষ কুলের অযোগ্যতার প্রমাণ। বড় লজ্জা আর অপমানের বিষয়। তাই তারা সমাজের অন্দরে কঠোর প্রহরা বসিয়ে বর্ণসংকর সৃষ্টির পথে বহু কাটা বিছিয়ে রেখেছিল। তবু কখন কখনো বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরোয় পর্যবসতি হয়ে যেত। ওই সমাজের কোন কোন নারী কোন শূদ্র পুরুষের পরিশ্রমী পেশিবহুল সুগঠিত শরীর আর তার মনের আদি অকৃত্রিম সারল্য দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়ত। তখন সে প্রলুব্ধ করত ওই পুরুষকে তার ইচ্ছে পূরণের সক্রিয় সহযোগী হবার জন্য। যার ফলে কখন কখনো সেই নারী সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ত।
শাস্ত্রের বিধান আছে, যদি কোন শুদ্র কোন ব্রাহ্মণ কন্যাতে উপগত হয়, তাকে নির্মমভাবে হত্যা করবার। এটা অনুমান করা কঠিন নয় যে একটি মহিলার আবেদন, আকুলতা কতখানি তীব্র হলে একজন পুরুষ প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ত। সে যাই হোক তখন সেই ব্রাহ্মণ কন্যার গর্ভে শুদ্র পুরুষের বীর্যে উৎপন্ন সন্তানকে উচ্চবর্ণ সমাজ আর তাদের সমাজে স্থান দিত না। তারা সেই সন্তানকে ঘোষণা করত অচ্ছুত অস্পৃশ্য চণ্ডাল বলে।
শাস্ত্র বলেছে–চণ্ডালের নিবাস হবে লোকালয় থেকে দূর কোন নির্জন নদী তীরে। শবদাহ ও শুয়োর কুকুর পালন হবে তার পেশা। পরিধান বস্ত্র হবে তার শবগাত্র থেকে খুলে ফেলা পরিত্যক্ত পরিচ্ছদ। শত প্রয়োজন হলেও রাত্রিকালে কোন নগরে প্রবেশ করতে পারবে না। একস্থানে দীর্ঘদিন বসবাস করবার অধিকারও থাকবে না। স্থান থেকে স্থানান্তরে সতত পরিভ্রমণ করে বেড়াতে হবে। বিদ্যার্জনের সুযোগ থাকবে না। রাখতে পারবে না কোন সুভদ্র নাম। সদা সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে যেন তার ছায়া কোন ব্রাহ্মণের শরীরে না পড়ে। শুধু মাত্র এই অপরাধে তার মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে।
নমঃশূদ্র সমাজের মানুষ রাজ রোষানলে–এক আদেশে সামাজিক সম্মানের নিজস্ব অবস্থান থেকে এক ধাক্কায় পতিত হল এই অসহ্য অপমানজনক নরকতুল্য জীবনের অন্ধকার গহ্বরে।
সে কবে কতকাল আগেকার কথা। সেন রাজত্ব শেষ হবার পর বঙ্গে এল মুসলমান শাসন। যা চলে প্রায় সাতশ বছর। এরপর আসে ইংরেজ শাসন। সেও চলে প্রায় দুশো বছর। এই ন’শ বছরে দেশ জ্ঞান বিজ্ঞান শিল্প সাহিত্য–নানা শাখায় কত না এগিয়ে গেছে। কিন্তু এক তিলও অগ্রগতি হয়নি আজও হিন্দুধর্মের বর্ণবাদী মানসিকতার। মানুষকে বিনা কারণে অপমানিত, প্রতারিত করবার যে ধর্মীয় বিধান তাকে আজও বর্জন করতে পারেনি। তারা তা বর্জন করতে চায়ও না।
নমঃশূদ্র থেকে চণ্ডাল হয়ে যাবার হাজার বছর পেরিয়ে আসার পর কেমন ছিল সেই মানব গোষ্ঠীর জীবনযাপন তা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৯১১ সালে লিখিত ধর্মের অধিকার শীর্ষক প্রবন্ধটি পাঠে অবগত হওয়া যায়। তিনি লিখেছেন–
“আমি পল্লী গ্রামে গিয়া দেখিয়া আসিলাম, সেখানে নমঃশূদ্রদের ক্ষেত্র অন্য জাতিতে চাষ করে না, তাহাদের ধান কাটে না, তাহাদের ঘর তৈরি করিয়া দেয় না। অর্থাৎ পৃথিবীতে বাঁচিয়া থাকিতে হইলে মানুষের কাছে মানুষ যে সহযোগিতা দাবি করিতে পারে আমাদের সমাজ ইহাদিগকে তাহারও অযোগ্য বলিয়াছে; বিনা অপরাধে আমরা ইহাদের জীবন যাত্রাকে দুরুহ ও দুঃসহ করিয়া তুলিয়া জন্ম হইতে মৃত্যুকাল পর্যন্ত ইহাদিগকে প্রতিদিনই দণ্ড দিতেছি।”
এত অসহযোগ অপমান অত্যাচার অভাব অনটন অনাহার তবু নমঃশূদ্র সমাজের মানুষ প্রাগঐতিহাসিক প্রাণীদের মত বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। আজও তারা স্বীয় ক্ষমতায় টিকে রয়েছে। এতেই তাদের জীবনীশক্তির প্রমাণ পাওয়া যায়।
এই দেশে সর্ব প্রথম জনগণনার কাজ শুরু হয় ইংরেজ শাসনকালে। ১৮৭২ সালে সেই প্রথম জনগণনার ভার এদেশীয় যে সব উচ্চবর্ণ রাজকর্মচারীদের উপর ন্যস্ত হয়েছিল তারা অভ্যাস এবং ঘৃণাজনিত কারণে নমঃশূদ্রদের জাতি পরিচয় স্থলে নমঃশূদ্র না লিখে চণ্ডাল লেখা শুরু করে দেয়। এরই প্রতিবাদে নমঃশূদ্র সমাজ প্রবল বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বরিশাল ফরিদপুর খুলনা যশোর নমঃশূদ্র অধ্যুষিত এই চার জেলায় এক সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়। তখন নমঃশূদ্র সমাজ জীবনে এক ঝলক আলো প্রবেশ করেছে। ১৮১২ সালে এই সমাজে জন্মেছিলেন হরিচাঁদ ঠাকুর নামে এক মহান মানুষ যিনি মারা যান ১৮৭৮ সালে। এঁর প্রবর্তিত মতুয়া ধর্মের মাধ্যমে সমস্ত নমঃশূদ্র সমাজের মানুষ তখন সংঘবদ্ধ হচ্ছিল। হরির্চাদ ঠাকুরের সুযোগ্যপুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর, যার জন্ম ১৮৪৮ সালে। গুরুচাঁদ ঠাকুরের উদ্যোগে খৃষ্টান ধর্মর্যাজক মিঃ মীড সাহেবের সহযোগিতায় ওড়াকান্দি সহ নানাস্থানে স্থাপিত হয়েছে অনেকগুলো স্কুল। “শিক্ষা আনে চেতনা”–জ্ঞানের আলো পেয়ে নমঃশুদ্র সমাজের মানুষ তখন আলোকিত হয়ে উঠেছে। তাই একদল তরুণ সেই অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে, সমাজ বদলের–সম্মানিত জীবনের স্বপ্নে এগিয়ে চলেছে। সে এক মহা জাগরণের সূচনাকাল, নিদ্রোথিত লক্ষ লক্ষ নমঃশূদ্রদের তখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন হরিচাঁদ ঠাকুরের সুযোগ্য পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর। বেদ ব্রাহ্মণ বিরোধী এক নতুন ধর্মমত “মতুয়া” ধর্ম সংগঠনের মাধ্যমে গুরুচাঁদ ঠাকুর তাদের সংঘবদ্ধ করে, সচেতন করে, মানুষদের মনে জ্বালিয়ে তুলেছেন আত্মসম্মানের দীপ্ত মশাল–আমরা কারও চেয়ে ছোট নই, কেউ বড় নয় আমাদের চেয়ে।তখন নমঃশূদ্র সম্প্রদায়। সংঘবদ্ধ এমন এক শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে যে তাদের ক্ষমতাকে অস্বীকার করবার সাহস কারও ছিল না। তারা ওই অপমানজনক চণ্ডাল শব্দ বদলের দাবিতে তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলল। অবশেষে গণ আন্দোলনের চাপে ইংরেজ সরকার ১৯১১ সালে নমঃশূদ্রদের সমস্ত সরকারি নথি পত্রে নমঃশুদ্র জাতি পরিচয় লেখবার আদেশ দেয়। সেই আদেশনামায় এদেশীয় রাজকর্মচারী গণকে সতর্কীকরণ করে বলা হয়, যদি কোন রাজকর্মচারী নমঃশূদ্রদের জাতি পরিচয় স্থলে নমঃশুদ্র না লিখে চণ্ডাল বা অন্য কোন অপমানজনক শব্দ লেখে তাহলে তার চাকরি হারাতে হবে, এই কারণে উচ্চবর্ণের সরকারি কর্মচারীরা আর চণ্ডাল লেখবার সাহস করে না। তখন থেকে নমঃ শূদ্ররা পাকাপাকি ভাবে নমঃশূদ্র নামেই স্বীকৃতি পেতে থাকে।