অগত্যা নিরুপায় রাজা আদিশূর দূর দেশ কান্যকুজ থেকে পাঁচজন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ আনার উদ্দেশ্যে একজন দূত পাঠালেন সে দেশে। দূতের নিকট গেল রাজা আদিশূরের আবেদন–বঙ্গে বৈদিক ধর্মের পুনঃ প্রতিষ্ঠাকল্পে যে মহাযজ্ঞের আয়োজন করা হয়েছে এতে আপনার সহযোগিতা চাই। কিন্তু কান্থকুজের রাজা বীরসিংহ আদিশূরের আবেদনে সাড়া দিয়ে বঙ্গে ব্রাহ্মণ পাঠাতে রাজি হল না। বঙ্গে নাস্তিকদের (বৌদ্ধ) প্রাদুর্ভাবে ধর্মকর্ম বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। সেখানে ব্রাহ্মণেরা গেলে সব স্বধর্মচ্যুত হয়ে পড়বে। সে পাপের দায়ভার রাজার উপরেই বর্তাবে। রাজা বীর সিংহ বড় ধর্মপ্রাণ মানুষ। তিনি কেমন করে এমন মহাপাতকী কর্ম করতে পারেন!
তখন রাজা আদিশূর আর কোন গত্যান্তর না দেখে অবশেষে মনঃস্থির করে ফেললেন, যে, যুদ্ধ করেই পাঁচজন ব্রাহ্মণ ধরে নিয়ে আসবেন। তৈরি হল সাতশত সাহসী যোদ্ধা। যে কোন যুদ্ধের প্রধান উদ্দেশ্য হয় বিজয়। তা সে ছলে বলে কলে কৌশলে যেভাবেই হোক না কেন। তাই আদিশূরের আদেশে সব সেনা গলায় পড়ে নিল একটা করে ধবধবে সাদা পৈতে। চড়ে বসল গরুর পিঠের উপর এবং একদিন তারা গিয়ে দাঁড়াল ‘রণং দেহী’ হুংকার দিয়ে কান্বকুব্জের রাজ্যের সীমানায়। হয় যুদ্ধ কর, নয় পাঁচজন ব্রাহ্মণ দিয়ে দাও। এই না দেখে ধর্মপ্রাণ রাজা বীরসিংহ পড়ে গেল মহা ফাপড়ে। এখন কান্যকুজের সেনা যদি প্রতি আক্রমণ করে, তাদের অস্ত্রে হয় গরু, নয় ব্রাহ্মণ কেউ না কেউ তো মারা পড়বে। বেদজ্ঞ যদি নাও হয় তবু তো ব্রাহ্মণ। শাস্ত্রে ব্রাহ্মণ এবং গরু দুটোকেই অবধ্য প্রাণী বলেছে। এদের যেকোন একটাকে বধ করলে মৃত্যুর পরে অনন্তকাল নরক বাস। নিরুপায় বীরসিংহ তখন পরাজয় স্বীকার করে পাঁচজন বৈদিক ব্রাহ্মণ বঙ্গে পাঠাবার শর্ত মেনে নিলেন। সেই পাঁচ ব্রাহ্মণ তাদের সেবা করার জন্য সাথে করে নিয়ে এল পাঁচজন সেবক। ওই পাঁচ ব্রাহ্মণ আর ওই পাঁচ ভৃত্য পরবর্তীকালে আর স্বদেশে ফিরে যেতে পারেনি। পাকাপাকিভাবে রয়ে গেছে বঙ্গদেশে। শূদ্র জাতির ওই পাঁচভৃত্য এদেশে পরিচিত হয়েছে এক নতুন জাতি হিসেবে কায়স্থ পরিচয়ে।
সে যাই হোক, আদিশূরের মহাযজ্ঞ তো মহা আড়ম্বরে সমাপ্ত হয়ে গেল। রাজা এখন মহাখুশি। এবার সেই সাতশত সেল্লাকে পুরস্কার দেবার পালা। ঝক্সবির্শে বিভুই থেকে পাঁচ পাঁচখানি অমূল্য রতন ধরে নিয়ে এসেছে। “বলো তোমরা কী চাও?” জানতে চাইলেন রাজা আদিশূর। তখন সেনাদের প্রধান এগিয়ে এল সামনে। বলল–মহারাজ আমরা আর কিছু চাইনা। শুধু এইটুকু নিবেদন, যা আপনি দিয়েছেন তা আর ফিরিয়ে নেবেন না। আমাদের এই পৈতাখানি পরে থাকার অনুমতি দিন।
আদিশূর অধার্মিক নন, অকৃতজ্ঞও নন। আদেশ দিলেন তিনি, আমার রাজত্ব সীমায় আজ থেকে তোমরা ব্রাহ্মণ বলেই পরিচিত হবে। সমাজে ব্রাহ্মণের যে সম্মান, তোমরাও আধিকারি হবে সেই সম্মানের।
রাজ্যবাসীগণ রাজার সেই আদেশ নত মস্তকে মেনে নিলেও বেঁকে বসল অনমনীয় নমঃশুদ্র সমাজ। নমসমুনির বংশধর আমরা। না হয় সামান্য ভুলে পৈতেটা পাইনি; তা বলে ওরা আমাদের চেয়ে বড় জাত হয়ে যাবে? আমরা ওদের কিছুতে ব্রাহ্মণ বলে মেনে নেব না। প্রণত হব না এই সব ব্রাহ্মণদের পায়ে। শুরু হয়ে গেল নব ব্রাহ্মণদের সাথে নমঃশূদ্র সমাজের বিরোধ। যা চলতেই থাকল।
এরপর সমগ্র বঙ্গভূমিতে এল সেন রাজত্বের কাল। রাজা হলেন বল্লাল সেন। কিছুকাল পরে রাজা বল্লাল সেন তার এক রক্ষিতার পুত্রকে সামাজিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করবার উদ্দেশ্যে এক পংক্তি ভোজের আয়োজন করলেন। নিমন্ত্রণ পাঠান হল রাজ্যের সর্বত্র। প্রতিটা জাতিগোষ্ঠি থেকে সেই ভোজ সভায় প্রতিনিধি এল কিন্তু এই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করল নমঃশুদ্র সমাজ। তারা বলল হোক রাজবীর্যে জন্ম, সন্তান তো রক্ষিতারই। আমরা অংশ নেব না ওই অনুষ্ঠানে।
রাজা প্রজাদের এই ঔদ্ধত্য সহ্য করবেন কেন! এতে ভীষণ ক্রদ্ধ হলেন বল্লাল সেন। নব ব্রাহ্মণরা তো নমঃশূদ্রদের উপর আগে থেকে বিরূপ হয়ে ছিলই। পূর্বাগ্রহ থেকে তারা রাজার ক্রোধকে আরও উস্কে দিল–”দেখলেন তো মহারাজ স্পর্ধাটা। এর একটা বিহিত করুন। ওদের কঠোর কোন সাজা দিন।” তাদের চাটুকারিতায় তুষ্ট হয়ে বল্লাল সেন কৌলিন্য প্রথার প্রবর্তন করে কিছু স্তাবক চাটুকারদের সমাজে উচ্চস্থান দিয়ে পুরস্কৃত করলেন আর শাস্তি দিলেন নমঃশুদ্র সমাজের মানুষকে সমাজচ্যুত করে। ঘোষণা করে দিলেন তিনি–“আজ থেকে এরা সব চণ্ডাল বলে গণ্য হবে। সমাজে চণ্ডালদের যে স্থান, নমঃশূদ্রদের প্রাপ্য হবে সেই স্থান।”
ভারতীয় বর্ণ ব্যবস্থায় চতুবর্ণ বিভাজনে সর্বোচ্চ স্থানে রাখা হয়েছে ব্রাহ্মণকে। যার নিচে ক্ষত্রিয় তার নিচে বৈশ্য এবং সবার নিচে শূদ্র। যাদের কাজ উপরোক্ত তিনবর্ণের সেবা করা এবং তাদের দয়া কৃপা দানের অন্নে জীবন নির্বাহ করা। যে কারণে শূদ্রের আর এক নাম দাস। বলা হয়ে থাকে যে ব্রহ্মার মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, উদর থেকে বৈশ্য ও পা থেকে শুদ্রের জন্ম। পা তো দেহের সব চেয়ে নিম্ন ও নিকৃষ্ট স্থান। যার উৎপত্তি ওই স্থানে সে আর উচ্চ হবার অধিকার কি করে পাবে। যে কারণে ওই তিন বর্ণের বিচারে শূদ্র এক হীন নীচ ঘৃণ্য মানবেতর প্রাণী। শাস্ত্র অনুসারে এদের জ্ঞান, বিদ্যার্জনের ধন সম্পদ সঞ্চয়ের, ভদ্রচিত পরিচ্ছদ পরিধানের কোন অধিকার নেই। যদি কেউ শাস্ত্রবিধি লঙ্ঘন করে তার জন্য প্রচলন আছে কঠোর শাস্তির। শম্বুক নামের এক শূদ্র বেদ পাঠ করার কারণে রামচন্দ্র তাকে হত্যা করেছিলেন।